কালের পুরাণ- ইমানদার এরশাদ! বেইমান সাহাবুদ্দীন!! by সোহরাব হাসান

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রটি যে অদ্ভুত, তার প্রমাণ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সাবেক স্বৈরাচারী শাসক। নয় বছর ধরে যে লোকটি অবৈধভাবে দেশ শাসন করেছেন, যাঁকে মসনদ থেকে তাড়াতে নূর হোসেন-তাজুলরা রাজপথে জীবন দিয়েছেন, সেই লোকটিই কিনা এখন দেশ, গণতন্ত্র ও সংবিধান সম্পর্কে জাতিকে সবক দিয়ে যাচ্ছেন।


গত সোমবার জাতীয় পার্টির সমাবেশে এরশাদ বলেছেন, ‘তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে একাদশ সংশোধনী বাতিল করবেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের বিচার করবেন।’ তিনি তাঁকে বেইমান বলেও গালাগাল করেন। কেন? বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নাকি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাঁর ও তাঁর দলের প্রতি বৈষম্য দেখিয়েছিলেন।
অকৃতজ্ঞতা আর কাকে বলে? ১৯৯১ সালে যে মানুষটি এরশাদকে গণরোষ থেকে বাঁচিয়েছেন, তাঁরই কিনা বিচার চাইছেন গণধিক্কৃত সাবেক স্বৈরশাসক। আর সেই সুযোগটি করে দিয়েছেন আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুই পুরোহিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
নবীন প্রজন্ম না জানলেও সেই সময়ের মানুষ জানে, কীভাবে ছাত্র-জনতা সেদিন এরশাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, কীভাবে গণরোষের ভয়ে তিনি সেনাভবনে লুকিয়ে ছিলেন। এরশাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন—এই খবর চাউর হলে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের চারপাশ ঘেরাও করে রেখেছিল। এমনকি গদিচ্যুত হওয়ার পরও এরশাদ পুনরায় ক্ষমতা দখলের জন্য ষড়যন্ত্র করেন।
পৃথিবীর কোনো দেশে পরিত্যক্ত ও গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শাসকেরা রাজনীতি করতে পারেন না। আইয়ুব, সুহার্তো, মার্কোস—কেউ পারেননি। আর্জেন্টিনা ও চিলির স্বৈরশাসকের বিচার হয়েছে। বাংলাদেশই কেবল ব্যতিক্রম। ১৯৮২ সালে এরশাদ নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে শুধু অবৈধভাবে ক্ষমতায় আরোহণই করেননি, অনেক মায়ের বুক খালি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টি করেছেন, উৎকোচ দিয়ে রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। রাষ্ট্রের মৌল চরিত্রবিরোধী রাষ্ট্রধর্ম আইন পাস করে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছেন। দুর্নীতি, অসততা ও অনৈতিকতায় তাঁর শাসনামল বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছিল। যে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে গণরোষ দেখা দেয়। (আজকের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এরশাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের মামলা করেছিলেন। এত দিন তিনি সেই মামলা পরিচালনার সুযোগ পাননি। আশা করি, এবার সরকারে থেকে তিনি মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করবেন।)
সেদিন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্থলে অন্য কেউ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকলে ৬ ডিসেম্বরের পরই এরশাদকে কারাগারে পাঠাতেন। কিন্তু সাহাবুদ্দীন ছিলেন বিচারপতি। তিনি এরশাদকে সেনাভবনেই থাকার সুযোগ করে দেন। পরে বিবিসিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা সম্পর্কে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পরই তাঁকে অন্তরীণ করা হয়েছিল। জাতীয় সংসদে তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি ও বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তাঁর গ্রেপ্তারের দাবিতে সোচ্চার ছিল। আবার তারাই পরবর্তী সময়ে এরশাদকে নিয়ে টানাটানি করতে দ্বিধা করেনি। কখনো তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধেছেন, কখনো শেখ হাসিনার সঙ্গে।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বিচক্ষণতার সঙ্গে যেমন বিচারিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনটিও তিনি জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক যে সেই সময়ে নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি ও পরাজিত আওয়ামীলীগ কেউই তাঁর অবদানকে স্বীকার করেনি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে বলেছিল, ‘সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।’ আর বিএনপি তাঁকে নানাভাবে অপমান করেছিল।
সংবিধানের যেই একাদশ সংশোধনী নিয়ে এরশাদ এখন বিষোদ্গার করছেন, সেই সংশোধনী সাহাবুদ্দীন আহমদ করেননি। করেছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলে। তিনি নিজের ইচ্ছায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেননি। ১৯৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হয়। প্রশ্ন দেখা দেয়, কে দেশের দায়িত্ব নেবেন? তিন জোট মিলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাব করে। কিন্তু তিনি বিচারিক পদ ছাড়তে চাননি বলেই তিন জোট সর্বসম্মতক্রমে তাঁকে আবার পূর্ব পদে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করে। একাদশ সংশোধনী ছিল সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রবীণ নেতারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, সেদিন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব না নিলে দেশে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। সাবেক স্বৈরশাসকের হয়তো সেটাই কাম্য ছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন নব্বইয়ে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত হতে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন। এ কারণেই এরশাদ তাঁর ওপর খাপ্পা। যে দেশে গুণীদের কদর নেই, সে দেশে সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে এরশাদের মতো ব্যক্তি অশালীন বক্তব্য দেবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রেক্ষাপটটিও ক্ষমতাসীনদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অবসর জীবন যাপন করছিলেন। ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করার অঙ্গীকার করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কাছে প্রস্তাবটি গেলে তিনি প্রথমে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন বললেন, তিনি রাজি না হলে তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে অনশন করবেন, তখন আর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি।
এরপর আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গে বড় ধরনের বিরোধ দেখা না দিলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে দলটি হেরে যাওয়ার পর দলটি তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলে, যা ছিল অসত্য ও ভিত্তিহীন। এমনকি তাঁকে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস নিয়েছিল।
সেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরোধিতার ধারাবাহিকতায়ই আজ এরশাদ এই সম্মানিত ব্যক্তিকে নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলার সাহস পাচ্ছেন।
ইতিহাসের পরিহাস হলো দেশ, সংবিধান ও গণতন্ত্রের সঙ্গে বেইমানি করা এরশাদই আজ ইমানদার সেজে বসেছেন। আর বেইমান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন দেশের ক্রান্তিকালে অনন্য ভূমিকা পালনকারী সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.