সচিবরা ব্যস্ত ছোট কাজে by আশরাফুল হক রাজীব

জনপ্রশাসনের সর্বোচ্চ পদধারী সচিবরা ছোটখাটো বা গুরুত্বহীন কাজে ব্যস্ত থাকেন। সারা দিনে তাঁরা যে কাজ করেন তাঁর ৬০ ভাগ জুনিয়র কর্মকর্তাদের নিষ্পত্তি করার কথা। কিন্তু জুনিয়র কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে হয়রানির ভয়ে বা দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এসব কাজ সচিবের কাছে ঠেলে দিচ্ছেন।


সচিবদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোসংযোগ করতে না পারার এটাও অন্যতম কারণ। মননশীল বা উদ্ভাবনী সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দূরে সরে তাঁরা রুটিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এর ফলে দফায় দফায় নির্দেশনা দিয়েও প্রশাসন গতিশীল করতে পারেনি সরকার। এতে সাধারণ মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সচিবদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ সমস্যা দূর করার জন্য নানা বিধিবিধান প্রণয়ন করা হলেও কোনো দাওয়াই-ই কাজে আসছে না। এমনকি কমিটি করে এ সমস্যা দূর করার কৌশল বের করা হলেও তার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রশাসন আরো গতিহীন হয়ে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। সাড়ে তিন বছর আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু কাজ দ্রুত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এজন্য বিদ্যমান কার্যপদ্ধতি ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু পদ অনুযায়ী ফাইল নিষ্পত্তি করার বিষয়টি কার্যকর করা হয়নি। ফলে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সহকারী সচিব থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত ফাইল চালাচালি করার রেওয়াজ অব্যাহত রয়েছে। এতে সময়ক্ষেপণ হয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব আতাহারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এই মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে আমি প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক ফাইলে কাজ করি। এসব ফাইলের ৬০ ভাগের বেশি উপসচিব, যুগ্মসচিব বা অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। তাঁরা দায়িত্ব না নিয়ে তা সচিবের কাছে ঠেলে পাঠান। জুনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে নিষ্পত্তিযোগ্য এসব ফাইলে কাজ করতে করতেই দিন শেষ হয়ে যায়। তারপর আর নতুন কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করার ইচ্ছাশক্তি থাকে না।
জানা গেছে, সচিবালয়ের কোনো কর্মকর্তার কী কাজ তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সচিবালয় নির্দেশমালায়। এমনকি কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা একটি ফাইল কতদিন সিদ্ধান্ত না দিয়ে তাঁর কাছে রাখতে পারবেন তাও সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যে কাজের দৃষ্টান্ত রয়েছে বা বিধিমালার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যাবে এমন বিষয় নিষ্পত্তি করবেন শাখার যেকোনো কর্মকর্তা। নীতিমালায় উপসচিবকেও কিছু বিষয় নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উপসচিব কোনো বিষয়েই নিষ্পত্তি করেন না। সচিবালয় নির্দেশমালায় কর্মবণ্টনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, 'গুরুত্বপূর্ণ নীতিবিষয়ক প্রশ্নজড়িত নহে অথবা যাহা বিধিমালা বা স্থায়ী আদেশবলে নিষ্পত্তির জন্য উপসচিব নিজেই ক্ষমতাপ্রাপ্ত, এমন বিষয়গুলো উপসচিব নিজেই নিষ্পত্তি করবেন।' নির্দেশমালায় যুগ্মসচিব বা অতিরিক্ত সচিবকে কিছু বিষয় নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাঁরা তা নিষ্পত্তি করেন না। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে নিষ্পত্তির সুযোগ থাকলেও তাঁরা সেখানে মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে সচিবের দারস্থ হন। সচিবালয় নির্দেশমালা অনুযায়ী শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সিনিয়র সহকারী সচিব যেকোনো বিষয় নিষ্পত্তির জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় পান। এ সময়ের মধ্যে তাঁকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হয়। উপসচিবকে তা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন। কিন্তু সচিবালয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা অনুসরণ করা হয় না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব বলেন, 'কেন আমরা যেকোনো কাজ ওপরের দিকে ঠেলে দেই তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কোনো কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা খুঁজে বের করা হয়। মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তাকে মন্ত্রীদের সঙ্গে আসামি হতে হয়েছে। কি দরকার আছে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর? এ কারণে আমি সচিবের স্বাক্ষর না নিয়ে কোনো কাজ করি না। তিনি বলেন, মামলা ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা হয়। পদোন্নতি দেওয়া হয় না। নানা ধরনের সমস্যায় ফেলা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব বলেন, কাজ না করেও কেউ কেউ পদোন্নতি পাচ্ছেন। পদোন্নতির সময় যদি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে বিবেচনায় নেওয়া হতো তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যেত। আমাদের যথেষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। কিন্তু তা আমলে নেই না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা গ্লোবাল ইন্টেগ্রিটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের উদাহরণ টেনে আনেন। সেখানে বলা হয়েছে, 'আইন বা বিধিবিধান তৈরিতে বাংলাদেশের অবস্থা যতটা ভালো তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে ততটাই খারাপ। এ কারণেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা বা দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল।'
জুনিয়র কর্মকর্তাদের ফাইল নিষ্পত্তির বিষয়টি বিভিন্ন কমিটি বা কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠন করা হয় আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ-সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটি। বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করে এ কমিটি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাজের চাপ কমাতে নিচের পর্যায়ে ফাইল নিষ্পত্তির তাগিদ দেয়। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের একটিতেও যথাস্থানে ফাইল নিষ্পত্তি হয় না। কর্মকর্তারা দায়িত্ব নিয়ে কোনো কাজ করেন না। সব ফাইল ওপরে পাঠিয়ে দেন। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সচিব কাজের চাপে ভারাক্রান্ত থাকেন। ফলে তাঁর পক্ষে নীতিনির্ধারণী কাজে বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হয় না।
বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জাহিদ হোসেন গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সচিবদের যা করা দরকার তাঁরা তা করতে পারেন না। তাঁরা যা করেন তার বেশির ভাগই জুনিয়র কর্মকর্তাদের কাজ। সচিবদের এসব কাজ থেকে দূরে রাখতে পারলে ভালো হতো। তাঁরা নতুন নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারতেন। এ বিষয়ে কমিটির প্রতিবেদন সরকার আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না।'
নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন সিনিয়র সচিব বলেন, একজন কর্মকর্তার মন্ত্রণালয়ে যোগ দিতে আসার ফাইলও সচিবের কাছে যায়। যার কোনো দরকার নেই। নিচের দিকের কর্মকর্তারা যদি তাদের ক্ষমতার বিষয়টি অনুভব করেন তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। অধিদপ্তরের রদবদলের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে আসার কোনো দরকার নেই। কিন্তু তার পরও সেগুলো মন্ত্রণালয় থেকে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে দপ্তর-অধিদপ্তরগুলোকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হলেও পরে তা প্রত্যাহার করা হয়।
জানা গেছে, সচিবালয় বা রাজস্ব খাতের প্রশাসনিক পদগুলোতেই নিচের দিকের কর্মকর্তারা দায়িত্ব নিতে চান না। তাঁরাই যখন উপসচিব হিসেবে কোনো প্রকল্পের প্রধান হন, তখন কোটি কোটি টাকার দায়িত্ব নেন। রাজস্ব খাতের বেলাতেই যত সমস্যা। প্রকল্পের দায়িত্ব নিচের দিকের কর্মকর্তা নিলেও রাজস্ব খাতে নেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সচিব বলেন, সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে আন্তমন্ত্রণালয় সভা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আন্তমন্ত্রণালয় সভায় যেসব জুনিয়র কর্মকর্তা যোগ দেন তাঁরা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। ফলে সমন্বিত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। জুনিয়র কর্মকর্তারা কাজ শেখার পরিবর্তে দলবাজি করে বেড়ান। রাজনৈতিক দলের পক্ষে-বিপক্ষে প্রকাশ্যে আলোচনা করেন। এসব দলবাজ কর্মকর্তারাই আগে পদোন্নতি পান। যাঁরা কাজ করেন তাঁদের পদোন্নতি মেলে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ২১ কমিটি ও কমিশন প্রশাসনিক কাজে গতি আনার কৌশল সম্পর্কে সুপারিশ করলেও সরকার তার কোনোটিই আমলে নেয়নি। সর্বশেষ শামসুল হক কমিশনের প্রতিবেদনেও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করা হয়। উপসচিব, যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব এসব ধাপে ধাপে ক্ষমতা অর্পণের বিষয়টি নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকার এ কমিশন গঠন করলেও তা হিমাগারে চলে গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, এসব কমিটির প্রতিবেদন বাস্তবায়নের হার খুবই কম। সরকার প্রশাসন নিয়ে ভাবলে এসবের সমাধান হতো। সব সরকারই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগী। প্রশাসনকে গতিশীল করার সদিচ্ছা থাকলে তা কোনো কঠিন কাজ নয়।
এদিকে এক বছর পর আজ সচিবদের নিয়ে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী নির্বাচন, পদ্মা সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি নির্দেশনা দেবেন বলে জানা গেছে। এসবের পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, রাজস্ব বাড়ানো, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে সচিবদের নির্দেশনা দেবেন। প্রশাসনকে আরো গতিশীল করতে এবং সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিতে এ বৈঠকে বসছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সরকারের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে সমন্বয় করে সচিবদের কাজ করার নির্দেশনা দেবেন বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী স্বাগত বক্তব্য দেওয়ার পর সচিবদের প্রতিক্রিয়া শুনবেন।

No comments

Powered by Blogger.