হারানো সুর by অজয় দাশগুপ্ত

বছর দুয়েক আগে রাঙামাটি গিয়েছিলাম এক সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য। দুই দশক পর ছিল এ সফর। আগেরবার, শহর সংলগ্ন লেকে নৌকায় ভ্রমণের সময় কিশোর মাঝির নৌকা কোনো কিছুর সঙ্গে বেশ জোরে ধাক্কা খায়। মাঝি বিষণ্ন কণ্ঠে বলেছিল_ রাজবাড়ির ছাদের সঙ্গে টক্কর খেয়েছে।


কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সময় রাঙামাটির রাজবাড়ি তলিয়ে গিয়েছিল এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সেখানের আদিবাসীদের ক্ষোভ-রোষ ছিল তীব্র। এটা ছিল ১৯৬০-৬১ সালের ঘটনা। শুষ্ক মৌসুমে লেকের পানি বেশি কমে গেলে রাজবাড়ির ওপরের অংশ দৃশ্যমান হয়। কিন্তু এই জনপদের প্রতি যে বঞ্চনা ও নিপীড়ন চলেছে দশকের পর দশক, তার অবসান এতে ঘটে না। রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ জেগে উঠলে প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুশি হতে পারেন, পর্যটকরা ছুটে যেতে পারেন; কিন্তু পার্বত্য ভূখণ্ডের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা ও বিকশিত করার প্রত্যাশারও যে এভাবে সলিলসমাধি ঘটেছিল সেটা বিস্মৃত হই কী করে?
রাজা ত্রিদিব রায়ের মৃত্যু হয়েছে সোমবার। বেঁচেছিলেন প্রায় আশি বছর। তার মৃত্যু ঘটে পাকিস্তানে এবং এ সময়ে সে দেশেরই নাগরিক ছিলেন। তার স্থায়ীভাবে পাকিস্তান চলে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদে জয়ী হন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের পক্ষ নেন। স্বাধীন বাংলাদেশে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের নিয়োগকৃত প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান একাত্তরে জাতিসংঘে যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন, রাজা ত্রিদিব রায় ছিলেন তার সদস্য। শাহ আজিজুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম সেনাশাসকের বদান্যতায় রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন; কিন্তু ত্রিদিব রায় রয়ে গেলেন পাকিস্তানে নির্বাসিত জীবনে। সেখানে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন, একাধিক দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের বাড়ির নাম রয়ে গেছে 'চাকমা হাউস'। তার মনপ্রাণ যে রয়ে গেছে বাংলাদেশেরই পাহাড়ি ভূখণ্ডে! এ চাকমা হাউসের ঠিকানা ব্যবহার করা একটি বই আমার হাতে আসে মাত্র মাসখানেক আগে। বইটির নাম 'উবঢ়ধৎঃবফ গবষড়ফু'. বাংলা কী করা যায়? হারানো সুর, নাকি স্মৃতি খুঁজে ফেরা? ভাষান্তর যাই হোক না কেন রাজা ত্রিদিব রায়ের নস্টালজিয়া এর ছত্রে ছত্রে। বইটি ২০০৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় সংস্করণ। তিনি চেয়েছিলেন বইটি বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হাতে পেঁৗছাক। এ জন্য তার পুত্র বর্তমান চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় উদ্যোগও নিয়েছিলেন। এ প্রক্রিয়ায় আমি যাতে সহায়তা করি সেটা তিনি চেয়েছেন এবং সেটা ত্রিদিব রায়ও জানতেন। ডেপারটেড মেলোডিতে তিনি লিখেছেন, চাকমা রাজারা বেশিদিন বাঁচেন না। পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যেই বেশিরভাগ রাজার জীবনাবসান ঘটে। তাদের তুলনায় তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন। বেঁচেছেন প্রায় আশি বছর। বইয়ে লিখেছেন, নিজের রাজ্যপাট ছেড়ে বাইরে থাকার কারণেই সম্ভবত এ বাড়তি জীবন পাওয়া। নিজ জনগণের কাছ থেকে দূরে পরবাসের জীবন যে খুব একটা প্রলম্বিত হবে না, সে শঙ্কা বারবার প্রকাশ পাচ্ছিল তার ই-মেইল বার্তায়। রাজা দেবাশীষও সেটা একাধিকবার বলেন আমায়। দুর্ভাগ্য, বইটি প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, কিন্তু তিনি চলে গেলেন!
রাঙামাটি থেকে ফিরে লিখেছিলাম, এ পাহাড়ি এলাকা আমি চিনি না। সেখানের ডেমোগ্রাফি বদলে দেওয়া হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। আদিবাসীরা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। পাহাড় পরিণত হচ্ছে 'সমতলভূমিতে'। একের পর এক বনভূমি উজাড় হচ্ছে। এতে কেবল পাহাড়িদেরই ক্ষতি হচ্ছে না, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের পরিবেশও বিপন্ন হচ্ছে। দক্ষিণে সুন্দরবন যেমন আমাদের অস্তিত্বের রক্ষাকবচ, তেমনি পুবের পাহাড়ও। যারা সহজ-সরল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপরে আঘাত হেনে চলেছে, তারা আসলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি করছে।
পার্বত্য ভূখণ্ডে শান্তি স্থাপনের জন্য ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগী হয়েছেন এবং এতে সফলতাও রয়েছে। তবে সব জট নিরসন হয়নি। আশা করব, এ প্রক্রিয়া পূর্ণতা পাবে এবং সেটাই হবে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন।
 

No comments

Powered by Blogger.