সাংবাদিকদের অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান- বিশ্বব্যাংকের টাকায় এই আমলে পদ্মা সেতু হবে না

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকারের বর্তমান মেয়াদে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান গতকাল মঙ্গলবার এই সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশের একটি চক্র এটাই চেয়েছিল। সেভাবেই তারা বিশ্বব্যাংককে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।


মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনের প্রধান ফটকে গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা। দেশের সব পত্রপত্রিকায় বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে তাঁর ছুটি নেওয়ার খবর প্রকাশ করা হয়। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্রে প্রকাশিত এই খবরের বিষয়ে মসিউর রহমানের বক্তব্য জানতে সকালেই সাংবাদিকেরা তাঁর বাসার সামনে জড়ো হতে থাকেন। দুপুর পৌনে ১২টায় তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।
ছুটি নেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে মসিউর রহমান বলেন, ‘আমার জীবনটাকে গুলাগে (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ অপরাধীসহ রাজবন্দীদের নির্বাসন দেওয়া হতো যেখানে) নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ তিনি সাংবাদিকদের কাছে সহানুভূতি চান এবং বলেন, ‘আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন। এই রকম চাপে যেকোনো লোকের হার্ট অ্যাটাক করতে পারে বা ব্রেইনস্ট্রোক করতে পারে।’
রাতে বিবিসি রেডিওকেও একটি সাক্ষাৎকার দেন মসিউর রহমান। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংককে গোপনে ই-মেইলের মাধ্যমে তথ্য দেওয়া হচ্ছিল। এসব ই-মেইলের কয়েকটি আমার কাছে এসেছে। সেই ই-মেইল থেকে দেখা যায়, কী হতে পারে, কী হতে পারে না—এসব তথ্য তারা বিশ্বব্যাংককে দিচ্ছিল। বিশ্বব্যাংক থেকে কেউ একজন বলল, “তোমাদের কাছ থেকে তো ভালো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাচ্ছি না।” তখন তাদের পক্ষ থেকে বলা হলো, “এর চেয়ে বেশি সাক্ষ্য-প্রমাণ দেওয়াটা সম্ভব নয়। কারণ, যারা এসব কাজ করে, তারা তো প্রমাণ রাখে না। তোমরা আমাকে বিশ্বাস করো এবং আর কিছু না পারো, প্রাইস বিড ওপেন (দরপত্রের দলিলাদি, যা কিনে ঠিকাদারদের মূল দরপত্রে অংশ নেওয়ার কথা) স্থগিত করে রাখো।” দেখা গেছে, প্রায় ১২ মাস বা তার চেয়ে বেশি সময় এই প্রাইস সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক টেন্ডার ডকুমেন্ট (দরপত্র দলিল) ধরে রেখেছে এবং এ সম্পর্কে কিছু বলেনি। এ থেকে সন্দেহ হয়, এরা যে পরামর্শ দিয়েছে, বিশ্বব্যাংক বুঝে বা না বুঝে এটাকে গ্রহণ করেছে এবং সে অনুসারে কাজ করেছে।’
তথ্য প্রদানকারীরা কারা হতে পারে—জানতে চাইলে মসিউর বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশ থেকে এটা করা হয়েছে। কিন্তু বেনামে করেছে, সে জন্য বলতে পারছি না। তাদের উদ্দেশ্য আমি বলতে পারব না। তবে যে পর্যায়ে এসেছে তাতে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংকের কাছে অনেক জিনিস ১২ থেকে ১৮ মাস ধরে পড়ে ছিল। তাদের ক্যানসেলেশন (ঋণচুক্তি বাতিল) এমন একটা সময়ে এসেছে যে, বিশ্বব্যাংক যে কাজগুলো ধরে রেখেছে, সেগুলো যদি তারা ক্লিয়ার (ছাড়) করতে চায়, তা হলে হঠাৎ করে এখন আর বলতে পারবে না যে এখানে কোনো ত্রুটি নাই। এখন ত্রুটি দূর করে যদি চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলেও অক্টোবরের আগে কোনো কাজ করা সম্ভব হবে না। যদি তারা এসব ত্রুটির কথা ১২ থেকে ১৮ মাস আগে বলত, এত দিনে সেগুলো শুদ্ধ করার সুযোগ থাকত। কিন্তু এমন সময় এসে চুক্তি বাতিল করেছে, যখন এগুলো শুদ্ধ করে কাজ শুরু করতে এই সরকারের কার্যকর মেয়াদ একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছাবে।’
বিবিসির কাছে মসিউর রহমান আরও দাবি করেন, ‘এটা সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করার বড় একটা উদ্দেশ্য থেকে করা হয়ে থাকতে পারে। এটা বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য—এ কথা আমি বলব না। কিন্তু এখান থেকে যারা অসত্য তথ্য দিয়েছে, তাদের একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে।’
তবে সকালে নিজ বাসার সামনে সাংবাদিকদের মসিউর রহমান বলেন, ‘আমাকে সরালে কাজ শুরু করবে বলে বলছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু আমি কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি, তাদের কাছে যতগুলো চুক্তি পাঠানো হয়েছে, তার একটি বাদে কোনোটিতেই তারা সম্মতি দেয়নি।’ তিনি আরও বলেন, যদি ঋণ না দিতে পারে, তা হলে এই সরকারের দায়িত্বভার ত্যাগ করার আগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলে তাঁর কাছে মনে হয় না।
এর আগে বিশ্বব্যাংক ‘না’ বলে দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রয়োজনে নিজেদের অর্থেই পদ্মা সেতু হবে। এ জন্য অনুদান হিসেবে অর্থ সংগ্রহেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, নিজেদের অর্থে বড় আকারে (গ্র্যান্ড স্কেলে) পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব না হলেও ‘ব্যবহার উপযোগী’ একটি সেতু বাংলাদেশ বানাতে সক্ষম। তিনি বলেন, ‘এটা করার সংগতি আমাদের আছে। চার থেকে পাঁচ বছরে করলে আমাদের গায়ে আঁচ লাগবে না।’
গতকালও অর্থ উপদেষ্টা অফিস করেননি, বাসায় কাজ করেছেন। গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকেও ছিলেন না। আগের দিনও অনুপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিসভার বৈঠকে। দুই বৈঠকেই সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর মানে তিনি কি ছুটিতে গেছেন—জানতে চাইলে বিষয়টিকে খোলাসা করেননি পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার বক্তব্য খুব স্পষ্ট। আমি বলি নাই যে, আমি ছুটির দরখাস্ত করেছি এবং দরখাস্ত দেওয়ার পরে যাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁরাও কেউ কিছু বলেননি। তবে অন্যরা বলছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমার বিবেচনায় ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গৌণ।’
আজ (গতকাল) অফিসে যাবেন কি না, এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে মসিউর বলেন, ‘আমি তো অফিস করি। আমার যেটা কাজ, সেটা করি।’ আবারও একই প্রশ্ন করে সাংবাদিকেরা তাঁর কাছে হ্যাঁ-না জবাব চান। তিনি বলেন, ‘আমি তো কাজ করছি।’ তা হলে কি ধরে নেব, আপনি ছুটিতে গেছেন—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনাদের ধরে নেওয়া না-নেওয়ার কোনো দরকার নেই।’
তবে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে না যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় মসিউর রহমান বলেন, ‘এক-দুই দিন আগে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে আমার উপস্থিতি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। তা এড়ানোর জন্যই মূলত মন্ত্রিসভার বৈঠকে যাইনি।’
মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠাতে গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ অন্যরা প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ অবশ্য গত সোমবারই মসিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান।
গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ: পদ্মা সেতু প্রকল্প ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রসঙ্গে মসিউর বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগও তোলেন। তিনি বলেন, ‘এরা আমাদের দেশের লোকদেরই গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দেয়।’
গুপ্তচরদের পরামর্শেই বিশ্বব্যাংক দরপত্র খোলা বন্ধ রেখেছে বলে মনে করেন মসিউর রহমান। তিনি বলেন, তারা গোপনে বিশ্বব্যাংককে তথ্য সরবরাহ করে, যার কোনো ভিত্তি নেই। গুপ্তচরেরাই বিশ্বব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে কখন, কী করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের এই গুপ্তচরবৃত্তিকে গর্হিত কাজ উল্লেখ করে মসিউর বলেন, এখন বড় বিষয় হলো, দেশের স্বার্থবিরোধী গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করা।
কারণ হিসেবে মসিউর বলেন, যারা তাদের (বিশ্বব্যাংক) সহযোগিতা করেছে, এখন তাদের (গুপ্তচর) রক্ষা করতে হবে। এই ‘গুপ্তচরদের’ কিছু ই-মেইল তাঁর কাছেও রয়েছে বলে দাবি করেন মসিউর। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এ বিষয়ে অবগত আছেন বলে জানান তিনি। গুপ্তচরদের পরিচয় জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘মেইলগুলো এসেছে বেনামে।’
গত আগস্ট মাসেও পদত্যাগ বা ছুটিতে যাওয়ার গুজব উঠলে নিজ বাসভবনের সামনে মসিউর রহমান নিজেকে এ ঘটনায় ‘বলির শিকার’ বলে দাবি করেন।
এই সরকারের সঙ্গে আর কাজ করা সম্ভব কি না—বিবিসির এই প্রশ্নের জবাবে মসিউর বলেন, ‘আমি মনে করি, এই সরকারে শুধু আমার কাজ করা সম্ভবই নয়, আমার কাজ করা উচিত। অন্য কোনো কারণে না হলেও এই পদ্মা সেতুর সাথে সরকারের কোনো দুর্নীতি ছিল না, আমার সাথে যে দুর্নীতির কোনো সম্পৃক্ততা নাই, সেটা প্রমাণ কারার জন্যই আমার কাজ করা উচিত এবং বিশ্বব্যাংককে বলা উচিত, যারা তোমাদেরকে অসত্য তথ্য দিয়েছে, সেই নামগুলো তোমরা প্রকাশ করো।’

No comments

Powered by Blogger.