'নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রবর্তন করতে পারে সংসদই'

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে অভিমত দিয়েছেন আপিল বিভাগের আরেক বিচারপতি মো. ইমান আলী। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদে আলোচনার মাধ্যমেই এই নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন হতে পারে।


পৃথকভাবে রায় লিখে তিনি এই অভিমত দেন। সেখানে তিনি বলেছেন, নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও গঠিত হতে পারে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রধান উপদেষ্টার নাম দেওয়ার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো পাঁচটি করে নাম দেবে। তবে কখনো রাজনৈতিক দলের পদধারী ছিলেন এমন কারো নাম দেওয়া যাবে না। সবার তালিকায় নাম রয়েছে এমন ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।
রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম না রেখে 'নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার' নাম দেওয়ার প্রস্তাব করে বিচারপতি ইমান আলী এসব অভিমত দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি রায়ে বলেছেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' শব্দযুগল অসহায় অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে। এটা ১৯৯৬ সালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, যখন আমাদের 'কেয়ার'-এর প্রয়োজন ছিল।
বিচারপতি মো. ইমান আলী তাঁর রায়ে আরো লিখেছেন, 'আমাদের সংসদের গণতান্ত্রিক চরিত্র অন্যান্য দেশের মতো নয়। আমাদের ব্যবস্থায় অনির্বাচিত ব্যক্তির টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। নারী সংসদ সদস্যদের সংসদের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। আমাদের গণতন্ত্র সত্যিকার গণতন্ত্র হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ থাকবে। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী এবং সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। যদিও এ রাষ্ট্রীয় কর্ম সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত। যদি সংবিধানের বিধান দ্বারা অনির্বাচিত মন্ত্রী এবং পরোক্ষভাবে নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যদের রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ থাকে, তাহলে ৯০ দিন অনির্বাচিত ব্যক্তিদের শাসন চাওয়ার মধ্যে কোনো ক্ষতি নেই, যখন জনগণ জানেন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এ সরকার গঠন করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক একটি মৌলিক কাঠামো এবং সংবিধানেরও মৌলিক কাঠামো।
রায়ে বিচারপতি ইমান আলী আরো বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর আরেকটি দিক হচ্ছে এর আওতায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেন ওই সরকার নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করতে পারে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে, এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে। দৈনন্দিন কার্যক্রমের পাশাপাশি নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ম্যান্ডেট একমাত্র নির্বাচন কমিশনের।
বিচারপতি মো. ইমান আলী ১৯৯৬ সালে সংসদে উত্থাপিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিলের কথা উল্লেখ করে বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একমাত্র কাজ হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা খুবই সীমিত। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, জনগণই ৭৫ থেকে ৯০ দিনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এনেছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। যাদের মনে রয়েছে অতীতের খারাপ অভিজ্ঞতা। রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক অবিশ্বাসের জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে একে অন্যকে বিশ্বাস করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।
রায়ে বিচারপতি ইমান আলী বলেন, যদি নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হয় তাহলে কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন সে প্রশ্ন গৌণ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনীত সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের অভিমতকেও যৌক্তিক বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই সমানসংখ্যক সদস্য পরিচালনার জন্য একজন দক্ষ ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.