ইলিশ ॥ জলের উজ্জ্বল শস্য by ইকবাল আজিজ

বাঙালীর জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশ জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। এক আশ্চর্য আনন্দ। ইলিশকে কেন্দ্র করে বাঙালীর উচ্ছ্বাস অনেকটা পদ্মা-মেঘনার টেউয়ের মতোই উত্তাল। কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ইলিশ ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। ইলিশ এখন খুব দামী মাছ।


অথচ প্রজনন ও বিচরণের ক্ষেত্রে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও গত সাত বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। দশ বছর আগে দেশে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হতো; বর্তমানে ইলিশ উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। ইলিশ উৎপাদন ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। কিন্তু এত উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও ইলিশ যেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্য এখন শুধুই স্বপ্ন। মাঝারি আকারের যে কোন ইলিশের দাম এখন ৮০০/৯০০ টাকা; এক কেজি কিংবা এর কাছাকাছি ওজনের ইলিশ ১২০০/১৫০০ টাকা। হ্যাঁ, এই বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিদিন এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের জীবনের সঙ্গে যা গভীরভাবে একাত্ম- আমাদের শৈশব কৈশোরের সেই অতি প্রিয় ইলিশ মাছ কি এখন শুধুমাত্র দর্শনীয় বস্তু? বিষয়টি বাস্তবিকই বেদনাদায়ক।
দেশব্যাপী ইলিশের উৎপাদন যতই বাড়ুক না কেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা গত চার দশকে বেড়েছে অনেক বেশি। বাজারে যে পরিমাণ ইলিশ আসছে তা দিয়ে দেশের সব মানুষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। অথচ পদ্মা-মেঘনা-যমুনার এই স্বপ্নিল ব-দ্বীপে এমন বাঙালী হয়ত কখনই খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি ইলিশ পছন্দ করেন না।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু সুস্বাদু নয়; একই সঙ্গে তা আমাদের শরীরের জন্যও উপকারী। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় জানা গেছে, ইলিশ মাছের তেল দেহের জন্য ক্ষতিকর কোলেস্টরলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে; এছাড়া ডায়াবেটিস রোগীর জন্যও তা বিশেষভাবে উপকারী। কিন্তু এত সুস্বাদু ও উপকারী ইলিশ মাছ বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যতালিকা থেকে যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের বাজারে চাহিদার চেয়ে এর সরবরাহ কম এ অবস্থাটি ইলিশের দুর্মূল্যের অন্যতম কারণ। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারত এবং বিশ্বের কয়েকটি দেশে বর্তমানে ইলিশ রফতানি হচ্ছে। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে প্রবাসী বাঙালীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে ইলিশের। মূলত প্রবাসী বাঙালীদের জন্য এসব দেশে নিয়মিত ইলিশ রফতানি হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা সম্পূর্ণভাবে না মিটিয়ে ইলিশ রফতানি কতখানি যুক্তিসঙ্গত? ইতোমধ্যে এ প্রশ্ন অনেকের মনে জেগেছে। ইলিশের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত উৎপাদন বজায় রাখার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করা দরকার। এছাড়া ইলিশের উৎপাদন যাতে ঠিক থাকে এজন্য পদ্মা-মেঘনা-যমুনাসহ বাংলাদেশের প্রধান নদীসমূহে নাব্য ও পর্যাপ্ত জলপ্রবাহ সারাবছরই নিশ্চিত করা দরকার। একই সঙ্গে নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। নদীর পানি যাতে ইলিশ মাছসহ অন্য সব ধরনের জলজ প্রাণীর বিচরণের উপযোগী থাকে সে বিষয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে এখন থেকে। দূষণের কারণে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে মাছসহ কোন জলজ প্রাণই বাঁচাতে পারে না; বুড়িগঙ্গা নদীর এ বিষাক্ত দূষণ ক্রমেই গ্রাস করছে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য নদী। এছাড়া বাংলাদেশে যে প্রক্রিয়ায় অপরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে তাতে নদী দূষণের আশঙ্কা বাড়ছে। ইলিশ মাছ সামুদ্রিক মাছ হলেও এরা ডিম পাড়ার মৌসুমে নদীর উজান বেয়ে অনেক দূর চলে যায়। বাংলাদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ বেশ কিছু নদী ইলিশের প্রজননস্থল। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইলিশ নদীর উজানে প্রায় ১২০০ মাইল পর্যন্ত যেতে পারে। এক সময় পদ্মার ইলিশ বাংলাদেশের রাজশাহী হয়ে ভারতের এলাহাবাদ পর্যন্ত বিচরণ করত। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সে পথ অনেকটা রুদ্ধ। একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী মনে করেন, ফারাক্কা বাঁধ ইলিশের স্থান পরিবর্তনের ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলেছে। তাঁর মতে, বাঁধের মধ্য দিয়ে স্থানান্তরের মতো ইলিশের যাতায়াতের একটি পথ রাখা যেত। বাংলাদেশে পদ্মা-মেঘনা-যমুনাসহ অসংখ্য নদী এখন পলি পড়ে নাব্য হারাচ্ছে। এসব নদীর পানি প্রবাহ ঠিক থাকলে ইলিশের উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি হতো। এ মাছ বাংলাদেশের প্রধান সব নদীতে পাওয়া গেলেও পদ্মার ইলিশের কোন তুলনা হয় না। মেঘনার ইলিশ যত বড়ই হোক না কেন পদ্মার ইলিশ স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। অথচ বর্ষার তিন চার মাস ছাড়া এখন সারাবছর পদ্মা নদীর বড় করুণ দশা। সেই প্রমত্ত পদ্মা আর নেই।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীকে বাঁচাতে হবে। তাহলে সাগরের ইলিশ ডিম ছাড়ার মৌসুমে নদীর অনেক উজানে আসবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে যে কয়টি ইলিশের অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছে তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। ইলিশের অভয়াশ্রমের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। এসব অভয়াশ্রমে জাটকা ও মা-ইলিশ সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশে ইলিশের সুদিন আবার ফিরে আসবে। আগের মতো বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি নদীতে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যায় সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে। এক সময় গোয়ালন্দ ও বিক্রমপুরের মাওয়া অঞ্চলের ইলিশ ছিল সবচেয়ে সুস্বাদু। যেসব ইলিশের পেট চওড়া ও গোলাকৃতি তা খুবই সুস্বাদু। মাঝারি সাইজের এই চওড়া পেটের ইলিশ বাস্তবিকই এখন দুর্লভ। ইলিশের হারিয়ে যাওয়া উৎসব নিয়ে বুদ্ধদেব বসু রচনা করেছিলেন একটি অসাধারণ কবিতা :
‘রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে/জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব;/ নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড়।/ তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে-ঘরে/ ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার/ সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ উৎসব।’
(ইলিশ)
হয়ত এসব কিছুর মধ্য দিয়ে একটি হাহাকার প্রকাশিত হচ্ছে। এ হাহাকার হলো ইলিশের জন্য। ইলিশ কি আসলেই স্বপ্ন হয়ে যাবে? বাঙালীর জাতীয় মাছ ইলিশকে আবার প্রতিটি বাঙালীর খাবার প্লেটে নিয়ে আসতে হবে। পরিকল্পিতভাবে ইলিশের উন্নয়নে সম্ভব সবকিছু করা দরকার। বাঙালীর হেঁসেলে এক সময় কত ধরনের ইলিশ রান্না যে চালু ছিল তার হিসাব নেই। সরিষা ইলিশ, দই ইলিশ, কচু ইলিশ, লাউ ইলিশ, বেগুন ইলিশ তো ঘরে ঘরে রান্না হতো।
এছাড়া ছিল ভাপে রান্না ইলিশ মাছের পাতুড়ি, ইলিশ পোলাও, ইলিশ ভাজা কিংবা ইলিশ মাছের কাবাব। এছাড়া পাবনা-নাটোর এলাকায় মাত্র ১৫ মিনিটে রান্না হতো ‘জাল দেয়া ইলিশ’ নামে ইলিশের এক অসাধারণ রেসিপি।
আগের মতোই ঘরে ঘরে ফিরে আসুক ইলিশ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
iqbalazizpoet.@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.