সংস্কারপন্থীরা চাপে আওয়ামী লীগে by পাভেল হায়দার চৌধুরী

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতাদের আবারও কোণঠাসা করার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকারের মেয়াদের শেষ ভাগে এসে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।


এ বিষয়ে খোলামেলা সমালোচনা করছেন দলের অনেকেই। মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়ার বিষয়ে তোফায়েল আহমেদ নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেও বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের অনেক নেতাই। দলের বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তোফায়েলের মন্ত্রিত্ব না নেওয়ার বিষয়টিকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ অনেকে। সৈয়দ আশরাফ দলীয় ফোরামে এমন কথা বলেছেনও। আবার অনেকে এ নিয়ে শেখ হাসিনার কান ভারী করছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, নতুন মন্ত্রীরা শপথ নেওয়ার পরের দিন সন্ধ্যায় গণভবনে শেখ হাসিনা দলের সভাপতিমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেন। তোফায়েল মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সেখানেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মন্ত্রিত্ব না নিয়ে তোফায়েল সাময়িক বাহবা কুড়ালেও ভবিষ্যতে এর জন্য তাঁকে বড় মাসুল দিতে হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভবিষ্যতে কার কপালে কী জুটবে সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না। তোফায়েল আহমেদ কেন মন্ত্রিত্ব নেননি, সেটাও জানি না। সে সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন। তবে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব পেয়ে থাকলে গ্রহণ করা দল ও সরকারের জন্য শুভ হতে পারত।'
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য ও মন্ত্রী বলেন, 'সংস্কারের তিলক যাঁদের কপালে আছে তাঁদের অবস্থান পাল্টেছে কি না, তা দেখতে মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব ছিল শেখ হাসিনার দিক থেকে এক ধরনের পরীক্ষা। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে তোফায়েল আহমেদ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি।' সরকারের শেষদিকে তাঁদের এমন আচরণ প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করেননি বলে জানান ওই মন্ত্রী।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বৈঠকে বলেন, তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্ব না নিয়ে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। তিনি সর্বশেষ প্রভাবশালী একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিত্ব না নেওয়া একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।
জানা গেছে, ওই বৈঠকে সংস্কারপন্থী নেতাদের বহিষ্কারের দাবি জানান দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ। মাহামুদুর রহমান মান্না, অধ্যাপক আবু সাইয়িদসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ রকম আরো অনেকে রয়েছেন, 'যাঁরা আওয়ামী লীগের পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত কথা বলে দলের ক্ষতি করছেন। এটা শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। জবাবে প্রধানমন্ত্রী এটাকে ভালো প্রস্তাব বলে মন্তব্য করেন। কার্যনির্বাহী সংসদের আগামী বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও জানান তিনি।
তোফায়েল আহমেদের মতো আরেক প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমুর গায়েও রয়েছে সংস্কারপন্থীর ছাপ। বিষয়টি নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হলেও কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু।
তোফায়েলের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করাকে রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ হিসেবে মন্তব্য করেছেন সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত আরেক নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। গত শনিবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, রাজনীতি সত্যিই বিচিত্র। তাঁর এ বক্তব্যও অনেকের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে বলে জানা গেছে।
তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্ব না নেওয়ায় সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতারা আবারও বেকায়দায় পড়লেন কি না জানতে চাওয়া হয় সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো পন্থী হিসেবে কাউকে চিনি না। সংস্কার বা পরিবর্তন সবাই চায়। এটা দোষের কিছু নয়।' মান্না বলেন, সরকারের সমালোচনা কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। তিনি সমালোচনা যা করেন তা গঠনমূলক। তা ছাড়া সংসদের ভেতরে-বাইরে সবাই তো সরকারের সমালোচনা করছে। তিনি কোনো অপরাধ করেননি।
এক-এগারোর পর জরুরি অবস্থার সময় সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়ায় বড় দুই দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা নিজ নিজ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের রোষানলে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলনে তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আমির হোসেন আমু ও আবদুর রাজ্জাককে সভাপতিমণ্ডলী থেকে সরিয়ে গুরুত্বহীন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বানানো হয়। আবদুল মান্নান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মাহমুদুর রহমান মান্না, হাবিবুর রহমানসহ অনেকেই কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়েন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, আখতারুজ্জামান, খ ম জাহাঙ্গীরসহ বেশ কয়েকজন গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকেও বঞ্চিত হন।

No comments

Powered by Blogger.