আমি, তুমি আর মোবাইল ফোন

একতরফা কথা বলতে সব সময় ভালো লাগে না। আমরা যাই লিখি না কেন সে আসলে এক ধরনের বক্তব্য। খুব কম লেখাতেই লেখক নিজের মনোভাব গোপন রেখে দিতে সক্ষম হয়। ‘বিষয়’ থেকে লেখক নিজেই কখনও নিবৃতি লাভ করতে পারে কি না সন্দেহ আছে।
ভালো লেখা বা খারাপ লেখা- লেখককে সব সময় এই জন্য সমালোচিত হতে হয় এবং ‘সঠিক লেখা’ বলে সেই অর্থে কিছু হয় না। বিশেষত আমি যে ধরনের লেখা লিখি তার বাস্তবতা কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কারও ক্ষেত্রে নয়। তাই এবার ভাবলাম ব্লগে এমন একটা লেখা লিখি যার মধ্যে দিয়ে পাঠকের সঙ্গে একটা সরাসরি ইন্টার-অ্যাকশন হতে পারে।
এই মাত্র কিছুদিন আগে হলো কী, আমার অত্যন্ত কাছের বান্ধবী তার সদ্য বিয়ে করা বরের ফোন চেক করতে গিয়ে দেখল, বান্ধবীর বরটি তার আগের দিনই অর্পিতা নামধারী কোন একটি মেয়ের সঙ্গে সল্টলেক জি ডি মার্কেট-এ সান্ধ্য-চা-সাক্ষাত করে এসেছে। যে এসএমএস-টি সে পড়ল তাতে লেখা -‘Meet you at 6pm in Market.’ এবং উত্তরে তার বর লিখেছে-‘OK, see you.’

বান্ধবীর বর তখন স্নান করছিল, ধরা যাক বান্ধবীর বরের নাম রাজা আর বান্ধবীর নাম রিনি, রাজা টয়লেট থেকে বেরিয়ে দেখল রিনি হাপুস নয়নে কাঁদছে আর বলছে, ‘তুমি আমাকে ঠকালে? আমি থাকতে তুমি আর একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছ? তাকে গোপনে চা খেতে নিয়ে যাচ্ছ?’

এবার বান্ধবীর বর প্রথমে বলল, ‘প্রেম ট্রেম কিছু নয়, অর্পিতা আমার পুরনো পরিচিত, ওর সঙ্গে এমনিই দেখা করেছি।’


‘কই, কোনওদিন তো অর্পিতার নাম শুনিনি!’

ঘটনাচক্রে রিনি থাকে কলকাতায় আর রাজা থাকে আমেরিকায়। এমনিতেই দু’জনে একসঙ্গে থাকতে পায় না, রাজা সদ্য আমেরিকা থেকে ক’দিনের জন্য এসেছে, তাই রিনি বলল, ‘তুমি এসেই একটা মেয়ের সঙ্গে আমাকে লুকিয়ে দেখা করতে গেছ? তুমি তো আমাকে সব কথা বলো, প্রতিদিনের খুঁটিনাটি সব বলো আর এই কথাটা লুকিয়ে গেলে? নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে... ।’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে রিনি অঝোরে কাঁদতে লাগল। প্রথমে রাজা রিনিকে যথেষ্ট সান্ত্বনা বাক্য শোনানোর পর এবার স্রেফ ডিফেন্সে বলতে লাগল, ‘তোমার সন্দেহবাতিক আছে। নইলে তুমি আমার ফোন চেক করলে কেন? কারও ফোন কারও চেক করার অধিকার নেই! এসব অন্যায়।’

ক্রমশ অর্পিতার সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গিয়ে দু’জনের মধ্যে জ্বলন্ত ইস্যু হয়ে উঠল একে অন্যের ফোন চেক করা। সেটা এমন মারাত্মক আকার নিল যে রাজা সর্বক্ষণ নিজের ফোন লুকোতে লাগল রিনির কাছ থেকে। স্নান করতে গেলে ফোন নিয়ে যেতে লাগল, রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ফোন ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রেখে সেই চাবি বালিশের খোলের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে লাগল। রিনি তাজ্জব! সে বলতে লাগল, ‘তুমি এত ডেসপারেটলি ফোন লুকোচ্ছো কেন? কী আছে তোমার ফোনে? কিছুই যদি না থাকবে তাহলে ফোন লুকোনোর দরকার কী?’

রাজার সেই এক কথা, ‘তোমার সন্দেহবাতিক। তুমি ট্রাবল-মেকার। তোমার সঙ্গে থাকলে তো আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে।’


রিনি বলতে লাগল, ‘তোমার মধ্যে স্বচ্ছতার অভাব। তুমি ডিজ-অনেস্ট। ফোন চেক করলাম বলেই তো জানলাম, তুমি তো আমাকে বোকা বানিয়ে রেখেছিলে।’

এই ঝগড়ার কোথাও কোনও সলিউশন হল না, দু’জনে তাণ্ডব করতে লাগল। ধীরে সেই অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষোভ অভিযোগ রাজা আর রিনির জীবনের সর্বত্র প্রবেশ করে প্রকাশিত হতে লাগল। দু’জনেই আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে বলতে লাগল এই ক্ষোভের কথা। রিনি বলতে লাগল, ‘রাজা অন্য মেয়ের সঙ্গে মেশে। রাজা কীভাবে ফোন লুকোয়। এভাবে কি একজনের সঙ্গে থাকা যায়?’

রাজা বলতে লাগল, ‘হাউ ডেয়ার শি চেক মাই ফোন? ওর সঙ্গে কী করে থাকা সম্ভব, ও আমাকে যখন এত সন্দেহ করে?’
ফাটল বাড়তে বাড়তে দু’জনের ডিভোর্স হওয়ার উপক্রম।

এর মধ্যে আমি আমার কিছু বন্ধুবান্ধবদের কাছে প্রশ্ন করেছি, আমি বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করেছি, ‘তোরা কি তোদের বরেদের-বয়ফ্রেন্ডদের ফোন চেক করিস? পাঠক, আমার সব বান্ধবীরা স্বীকার করেছে তারা করে, করেই থাকে। কেউ কেউ বলেছে, ‘নেভার ট্রাস্ট আ ম্যান, ওকে?’

আমি আমার বন্ধুদের বউদের এক প্রশ্ন করেছি, তারা বলেছে, ‘না, না, আমি আমার বরের ফোন চেক করি না।’ কিন্তু বন্ধুরা স্বীকার করেছে, ‘আমি জানি আমার বউ আমার ফোন চেক করে।’

রাজা বা রিনির সম্পর্কের পরিণতি কী হবে আমি জানি না, কিন্তু পাঠকদের কাছে আমি ট্রু কমেন্ট চাই। মহিলাদের জিজ্ঞেস করি, ‘আপনারা কি আপনাদের সঙ্গীর ফোন চেক করেন?’ পুরুষদের কাছে জিজ্ঞাসা, ‘বউরা ফোন ঘাঁটে নাকি?’

একটা প্রশ্ন হলো কোনটা বাস্তব? ফোন ঘাঁটাটা কি বাস্তব? নাকি রিনি একাই এই দোষে দুষ্ট? অন্য প্রশ্নটা হল নীতির। সঙ্গী বা সঙ্গীনির পারমিশন না নিয়ে তার ফোন চেক করাটা কি অনৈতিক কাজ? যা নৈতিক, যা হওয়া উচিত আর যা বাস্তবে ঘটে তার মধ্যে সব সময় বিস্তর পার্থক্য থাকে। আপনারা আমাকে জানান ভুলটা কে করছে? রাজা না রিনি?

পরিশেষে জানাই, গত দশ বছরে বহু বিয়ে ডিভোর্সে পরিণত হয়েছে স্বামী বা স্ত্রীর ফোনের মাধ্যমে অন্য নারী বা অন্য পুরুষের অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ায়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে প্রেম-ভালবাসা-যৌনতা একদিন থিতিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সম্পর্কের দাবিটা যেহেতু তখনও কমে না, তাই অন্য নারী বা পুরুষের উপস্থিতি ঝড়ঝঞ্ঝাট বয়ে আনে শুধু- আমার তো তাই মনে হয়!

No comments

Powered by Blogger.