সংবাদ বিশ্লেষণ- শুভ হোক ‘ছুটি’ by আনিসুল হক

বালাই ষাট! মসিউর রহমান, আপনি বহাল তবিয়তে থাকুন। আপনার যেন ব্রেইনস্ট্রোক না হয়, আপনার হার্ট যেন ফেইল না করে! মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা, আপনাকে যা নিতে হচ্ছে, তা ছুটিই তো, এর বেশি কিছু তো নয়!
সৈয়দ আবুল হোসেন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে ‘দেশপ্রেমিক’ খেতাব পেয়েছেন। আপনি যদি ছুটি নিয়ে থাকেন,
আর আপনার ছুটির কাগজ নিয়ে যদি বিশ্বব্যাংকের দুয়ার অভিমুখে সরকারের প্রতিনিধি উড়াল দিয়েই থাকেন, তা হলে সেটা স্বীকার করে নিতেই বা অসুবিধা কী! আপনাকেও আমরা দেশপ্রেমিকই বলব। আপনি যা করছেন, তা দেশের স্বার্থে, এটা বোঝার মতো বুদ্ধি দেশের মানুষের আছে।
সত্য বটে, পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের টাকা নিতে আমাদের সরকারকে যেসব শর্তের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, তা সম্মানজনক নয়। কিন্তু সেতুটা যে আমাদের বড় প্রয়োজন, আর ওটা যে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। আর সেতু বানাতে হলে বিশ্বব্যাংকের তহবিলের চেয়ে সহজ ও বাস্তব আর কোনো বিকল্প উৎস আমাদের হাতে আপাতত নেই। কাজেই ওদের বাতলে দেওয়া সব ঢেঁকিই আমাদের গিলতে হচ্ছে। সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছেন, সেতু বিভাগের সচিবকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, প্রকল্প পরিচালকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে, দুদক গঠন করেছে নতুন তদন্ত দল। সর্বশেষ পদক্ষেপ, মসিউর রহমান সাহেব, আপনার ছুটি। ছুটি যদি আপনি নিয়েই থাকেন, তা হলে গলা পরিষ্কার করে স্পষ্ট উচ্চারণে বলুন, হ্যাঁ, ছুটি নিয়েছি। আর যদি না নিয়ে থাকেন, তা হলে তা-ও বলুন, নিইনি। আপনার স্ট্রোক করবে, হূৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে—এসব কথা বলবেন না, বুকে বড় ব্যথা লাগে।
আপনি যদি ছুটি নিয়ে থাকেন, তা হলে আমরা, এ দেশের নাগরিকেরা এখন জোর গলায় আওয়াজ তুলব—বিশ্বব্যাংক, এবার পদ্মা সেতুর প্রকল্পে তহবিল দিন। আর যদি না নিয়ে থাকেন, তা হলে বিশ্বব্যাংকের দুয়ার বন্ধ করেই দেওয়া হলো, সেটাও স্পষ্ট করে বলুন, ঝেড়ে কাশুন—আমরা বিশ্বব্যাংকের টাকা চাই না।
প্রথম থেকেই একটা ঢাকঢাক-গুড়গুড় অবস্থা চলছে বিশ্বব্যাংক ও পদ্মা সেতু নিয়ে। সরকার সেই তো বিশ্বব্যাংকের সব শর্তই পূরণ করল। কিন্তু হাত থেকে একটা করে সুযোগ ফসকে যাওয়ার পর। ২৯ জুনের আগে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে হয়তো বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলও করত না। আর সব সময়ই চলছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা। সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন, কিন্তু সেই পদত্যাগপত্র ঝুলন্ত থাকে। অর্থ উপদেষ্টা ছুটিতে যান, কিন্তু তিনি তা স্বীকার করেন না। সরকারের দিক থেকে হয়তো আশঙ্কা, আসলে যাই করা হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না। তা যদি হয়, তা-ও তো স্পষ্ট করে সরকারের বলা উচিত, আমরা সব শর্ত পূরণ করেছি, আমাদের দিক থেকে আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। তখন দেশের জনগণ সরকারের পক্ষে দাঁড়াবে, সরকারের ডাকে পদ্মা সেতুর তহবিল গড়তে আমাদের নাগরিকেরা যথাসর্বস্ব নিয়ে এগিয়ে আসবে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে কি আমরা যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়িনি?
মুখে বলব, না, বিশ্বব্যাংকের টাকা আমরা নেব না। আর ভেতরে ভেতরে টাকার জন্য ধরনা চলতেই থাকবে, ছুটির চিঠি নিয়ে রাজার বাহক ছুটবে বিশ্বরাজধামে, আর হর্সেস মাউথ থেকে আমরা শুনব, ‘যে দরখাস্ত করবে, আর যিনি গ্রহণ করবেন, তারা কিছু বলছেন না, বলছে অন্যরা।’ এটা তো গ্রাম্য-রাজনীতিও নয়, এটা তো রান্নাঘরে ননদ-জায়ের ঝগড়ার মতো! যা বলি, তা বোঝাই না। যা করি, তা বলি না। বুক ফাটে, মুখ ফোটে না।
সরকারের মাথা যখন নিচু হয়, তখন দেশাবাসীরও মাথা নিচু হয়। আমরা চাই আমাদের সরকার মাথা উঁচু করেই চলুক। কিন্তু ভারত যখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের তহবিল নেয়, চীন-ব্রাজিল তাকে সমঝে চলে, আমরা তখন ‘গ্রাম্য’ কূটনীতি দিয়ে কেন পরিচালিত হলাম? আমাদের কোন সর্ষের মধ্যে কোন ‘ভূত’?
মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা, আমরা আদার ব্যাপারি, সব খোঁজ রাখি না, কিন্তু এটুকু জানি, ভিলেজ পলিটিক্স দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে স্বার্থোদ্ধার করা যাবে না।
আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। হ্যাভ এ নাইস হলিডে।

No comments

Powered by Blogger.