সংসদ সচিবালয়ে নিয়োগ- আ.লীগের আগের আমলে আত্তীকরণ, এবার পদোন্নতি by তানভীর সোহেল

আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে ২১ জনকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে আত্তীকরণ করে। এবার ক্ষমতায় এসে তাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অথচ উচ্চ আদালত ওই আত্তীকরণকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। মামলাটি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।


আত্তীকৃতদের মধ্যে ১৩ জন প্রথম শ্রেণীর ও আটজন দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চাকরিপ্রাপ্তদের বঞ্চিত করে এঁদের পদোন্নতি দেওয়ায় সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই ২১ জনকে নিয়োগ দিতে গিয়ে নিয়োগবিধির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আর পদোন্নতি দিতে নিয়োগবিধিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।
গত বছরের ৮, ৯ ও ১০ মার্চ বাছাই কমিটির সভায় আত্তীকৃতদের পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সে সময়ের সংসদ সচিবালয়ের সচিব আশফাক হামিদ।
জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের বর্তমান সচিব মাহফুজুর রহমান কাগজপত্র না দেখে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব জানান, সরকারের কর্মচারী নন, এমন ব্যক্তিদের স্পিকারের ক্ষমতাবলে নিয়োগ দিয়ে ২০০০ সালের ৯ আগস্ট সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। ১১ সেপ্টেম্বর সংস্থাপন মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারের কর্মচারী নন, এমন ব্যক্তিদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে আত্তীকরণের সুযোগ নেই।
প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও বর্তমান স্পিকার আবদুল হামিদ, সাবেক চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ ও হুইপ মিজানুর রহমানের সহকারী একান্ত সচিবেরা (এপিএস) রয়েছেন। এপিএস নিয়োগে ব্যক্তির পছন্দ গুরুত্ব পায়।
এপিএস থেকে প্রথম শ্রেণী: অমলেন্দু সিংহ হুইপ আব্দুস শহীদের এপিএস ছিলেন। তাঁকে লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে অনিয়মিত কর্মকর্তা হিসেবে সুনামগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। এবার পদোন্নতি পেয়ে তিনি সিনিয়র লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান হয়েছেন।
সামিয়া হোসাইন সাবেক স্পিকারের এপিএস-২ ছিলেন। তিনি সহকারী সচিব পদে নিয়োগ পান। পদোন্নতির পর সিনিয়র সহকারী সচিব হয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম বাদশা স্পিকারের এপিএস-১ ছিলেন। সেখান থেকে কমিটি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। এখন তিনি সিনিয়র কমিটি কর্মকর্তা। চৌধুরী আশরাফ আলী স্পিকারের এপিএস-২ ছিলেন। নিয়োগ পান গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে।
আবদুল হাই বর্তমান স্পিকার আবদুল হামিদের ভাই ও আগের আমলে তাঁর এপিএস ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন তিনি উপপরিচালক হয়েছেন।
সাবেক হুইপ মিজানুর রহমানের এপিএস এম এ মাসুম প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হয়েছেন। মালেকা পারভীন সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর এপিএস থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামার পদে নিয়োগ পান।
অগ্রণী ব্যাংকের জুনিয়র কর্মকর্তা এ কে এম জি কিবরিয়া মজুমদার সংযুক্তির মাধ্যমে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির সভাপতির একান্ত সচিব (পিএস) হন। আত্তীকরণ করে তাঁকে কমিটি কর্মকর্তা করা হয়। এখন তিনি সিনিয়র কমিটি কর্মকর্তা হয়েছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে মেভিজ জেসমিনকে উপসচিব পদে আত্তীকরণ করা হয়। এর আগে তিনি পর্যটন করপোরেশনের (হোটেল অবকাশে কর্মরত) একজন ব্যবস্থাপক ছিলেন। করপোরেশনের ব্যবস্থাপককে উপসচিব করতে তাঁকে করপোরেশনের বেতনে সংসদ সচিবালয়ের উপসচিব পদে প্রেষণে আনা হয়। তিনি এখন অবসরে আছেন। আবদুল কাদের জিলানীকে কমিটি কর্মকর্তা হিসেবে আনা হয়। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কম্পট্রোলার পদে ছিলেন।
এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এস এম মঞ্জুর, তারিক মাহমুদ, সরকারি কলেজের শিক্ষক মো. এনামুল হক সংসদ সচিবালয়ে প্রেষণে নিয়োগ পান সহকারী পরিচালক হিসেবে। সেখান থেকে তাঁদের আত্তীকরণ করা হয়। পদোন্নতির পর তাঁরা উপপরিচালক হয়েছেন।
মাস্টাররোল থেকে কর্মকর্তা: আটজনকে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এঁরা সবাই মাস্টাররোলে (দৈনিক ভিত্তিতে) সংসদ সচিবালয়ে কাজ করছিলেন। এঁদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা/ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নিয়োগবিধি’ মানা হয়নি। এঁদের মধ্যে এ বি এম সাইফুল ইসলাম, এস এম জহিরুল ইসলাম, খালেকুজ্জামান, সুজিত কুমার দে ও সালমা খাতুনকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে; এ কে এম আহসান উদ্দিন দেওয়ানকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা; মো. আলী আহমদ সহ-এস্টেট কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেয়েছেন। মো. হোসাইন গবেষণা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পান। তিনি মাস্টাররোলে সাবেক স্পিকারের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন।
যেভাবে নিয়োগ ও পদোন্নতি: নিয়ম অনুযায়ী যত দিন প্রয়োজন তত দিন ওই পদে আত্তীকৃতদের থাকার কথা। আর প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্তদের পুরোনো কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার কথা।
কিন্তু হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৯৪-এর ৭ নম্বর বিধি সংশোধন করে এঁদের সংসদ সচিবালয়ের নিজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে আত্তীকরণ করেন। আত্তীকৃতদের পূর্ব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের তারিখ থেকে আর যাঁরা কোনো চাকরি করতেন না, তাঁদের সচিবালয়ে নিয়োগের তারিখের দিন থেকে জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। ফলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কেউ কেউ আত্তীকৃতদের চেয়ে চাকরিতে কনিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
বিষয়টি জানতে চাইলে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন।

No comments

Powered by Blogger.