ভুঁইফোড় সংগঠন নিয়ে বিপাকে বিএনপি by শরীফুল ইসলাম

বিএনপি নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভুঁইফোড় সংগঠনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান দলের বর্তমান চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইসচেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রায় অর্ধশত ভুঁইফোড় সংগঠন সারাবছর ধারাবাহিকভাবে মনগড়া কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে।


আর এসব কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে তারা ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি করছে। বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বে¡ও ভূঁইফোড় সংগঠনগুলো দল এবং দলের নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে কর্মসূচী পালন বন্ধ করছে না। বরং ইদানীং এসব সংগঠনের তৎপরতা আরও বেড়ে গেছে। তাই এসব সংগঠন নিয়ে বিএনপি এখন বিপাকে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা একটি ভুঁইফোড় সংগঠন প্রায় প্রতিদিনই জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ফটো জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন ও ভাসানী মিলনায়তনসহ রাজধানীর বিভিন্ন হলরুম ভাড়া নিয়ে সেমিনার, মতবিনিময়সভা, আলোচনাসভা ও গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এ ছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রায়ই তারা বিভিন্ন দাবিতে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করে থাকে। এসব কর্মসূচীতে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের প্রধান অতিথি করা হয়। এ ছাড়াও বিএনপি ও জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বিশেষ অতিথি করা হয়। এর বাইরে ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত ব্যবসায়ীদের এসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন জানানো হয়। মূলত অনুষ্ঠানের খরচ দেন তাঁরাই। মঞ্চে ওসব নেতার পাশে বসেন ভুঁইফোড় সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও। অনেক সময় আমন্ত্রিত অতিথিদের বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পাশে বসানোর নাম করেও তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতারা।
এদিকে দেশবিদেশে একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকায় সোমবার বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলের দফতরের দায়িত্বে নিয়োজিত যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় জাতীয়তাবাদী তরুণ দল, জাতীয়তাবাদী বন্ধুদল, জিয়া ব্রিগেড, জিয়া মঞ্চ, দেশনেত্রী পরিষদ, তারেক রহমান পরিষদ, তারেক রহমান মুক্তি পরিষদসহ কতিপয় ভূঁইফোড় সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির কোন সম্পর্ক নেই। এসব সংগঠনের সঙ্গে দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। রিজভী বলেন, দেশব্যাপী বিএনপি, জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে এ সব ভূঁইফোঁড় সংগঠন কার্যক্রম চালাচেছ, যা সারাদেশের নেতাকর্মীদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও এর সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওইসব ভুঁইফোড় সংগঠন সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
খোঁজ নিয়ে বিএনপি সমর্থিত অনেকগুলো ভুঁইফোড় সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে। এসব সংগঠন ও এর নেতৃত্বে রয়েছেন যাঁরা তাঁদের কেউ কেউ বিএনপির নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছেন। যেমন স্বাধীনতা ফোরামের সভাপতি আবু নাসের মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ, নাগরিক সংসদের সভাপতি খালেদা ইয়াসমিন, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের সভাপতি মেজর (অব) মেহবুব রহমান, সম্মিলিত সমন্বয় পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মোঃ মঞ্জুর হোসেন ঈসা, জিয়া সেনার সভাপতি আবদুর রহমান তপন ও স্বদেশ জাগরণ পরিষদের সভাপতি মোঃ কামরুজ্জামান সেলিম, দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি বিএনপির সাবেক এমপি ডা. দেওয়ান মোঃ সালাউদ্দিন, দেশপ্রেমিক ফোরামের সভাপতি কমিশনার রাজিয়া আলীম, জিয়া স্মৃতি সংসদের সভাপতি আব্দুল মান্নান জমাদ্দার, জিয়া নাগরিক ফোরামের সভাপতি মিয়া মোঃ আনোয়ার, জিয়া আদর্শ একাডেমির সাধারণ সম্পাদক এম.এ রশিদ, তৃণমূল দলের সভাপতি মোঃ হানিফ বেপারী, চেতনায় ’৭১-এর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু, জিয়া ব্রিগেডের সভাপতি জাহিদ ইকবাল ও সচেতন নাগরিক ফোরাম সভাপতি হাফিজুর রহমান টিপু।
এ ছাড়াও অন্য ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর মধ্যে চেতনায় মুক্তিযোদ্ধার সভাপতি আব্দুল হান্নান, আমরা ’৭১-এর সভাপতি ইসমাইল হোসেন, জাগ্রত জনতা ফোরামের সভাপতি সহিদ চৌধুরী, আমাদের কথা নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইমদাদুল হক মিলন, গণমুক্তি আন্দোলন পরিষদের সভাপতি একেএম আব্দুর রহমান, বাসাসের সভাপতি আবু আল ইউসুফ টিপু, নাগরিক অধিকার সোসাইটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, গণতান্ত্রিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি রমিজ উদ্দিন রুমি, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জোটের সমন্বয়কারী রওশন আমিন রুমী, প্রজন্ম একাডেমীর সভাপতি কালাম ফয়েজী।
ভুঁইফোড় আরও সংগঠনের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের সমন্বয়কারী মনিরুজ্জামান মনির, সুশীল ফোরামের সভাপতি মোঃ জাহিদ হোসেন, নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ প্রধান সমন্বয়কারী এ্যাডভোকেট হাবিব মিয়াজী, হৃদয়ে বাংলাদেশের সভাপতি মেজর (অব) মোঃ হানিফ, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরামের সভাপতি সাইদুর রহমান, তৃতীয় স্বর সভাপতি লায়ন ড. ফিরোজা ইসলাম, দেশপ্রেমিক যুবশক্তির (একাংশ) সভাপতি আহসান উল্লাহ শামীম, দেশপ্রেমিক যুব শক্তির (অপর অংশ) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহিল মাসুদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জোটের সমন্বয়ক হুমায়ূন কবির বেপারি, সচেতন নাগরিক পরিষদ চেয়ারম্যান মেজর (অব) মিজানুর রহমান , গ্রুপ-৯ সভাপতি সাইফুল ইসলাম, আমরা ঢাকাবাসীর সভাপতি শামীম তারেক, ট্রাস্ট টেলিমিডিয়া লিমিটেডের সমন্বয়কারী কমিশনার আবুল বাশার ও বাংলাদেশ সচেতন যুব সমাজ উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু চৌধুরী। বিএনপিপন্থ’ী ভুঁইফোড় সংগঠনের মধ্যে এ ছাড়াও রয়েছে সচেতন দেশপ্রেমিক ফোরাম, জিয়া নাগরিক সংসদ, সামাজিক আন্দোলন সংস্থা, নর্থবেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল, গণতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, সচেতন যুব সমাজ ও স্বদেশ মঞ্চ।
জানা যায়, ১৩ সেপ্টেম্বর তারেক রহমানের নাম ভাঙ্গিয়ে একটি ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতা আবুল বাশার রাজধানীতে এক ব্যসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়ার খবর পেয়ে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে ওই ব্যক্তি এর আগেও ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার পরই বিএনপি হাইকমান্ড বিষয়টির দিকে নজর দেয়। ১৪ সেপ্টেম্বর বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আবুল বাশার নামে এক ব্যক্তি নিজেকে একটি সার্ভে কোম্পানির কনসালটেন্ট দাবি করে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা নেয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। এসব প্রতারকের সঙ্গে কোন লেনদেন না করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারকচক্র টাকা হাতিয়ে নেয়ার অপতৎপরতায় লিপ্ত আছে। এদের থেকে সবাইকে সাবধান থাকার অনুরোধ জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে এ বক্তব্য দেয়ার চার দিনের মাথায় সোমবার রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিএনপির কোন সম্পর্ক নেই।
ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচীতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে। তিনি প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের কোন সংগঠন আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকেন। এ ছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আসম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে এসব সংগঠনের প্রধান অতিথি হতে দেখা যায়। এ ছাড়াও মাঝে মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এমকে আনোয়ার, ড. আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খানসহ বিএনপির অন্যান্য সিনিয়র নেতাকে এসব সংগঠনের কর্মসূচীতে প্রধান অতিথি হতে দেখা যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে স্বাধীনতা ফোরামের সভাপতি বিএনপি নেতা আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ বলেন, এক এগারোর সময় রাজনৈতিক নেতারা যখন বাইরে বের হতে পারেননি তখন এসব সংগঠন অনেক ভূমিকা রেখেছে। কিছু কিছু সংগঠনের নামে নানা অভিযোগ পাওয়ায় দল হয়ত এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। দল না চাইলে আমরা কার্যক্রম বন্ধ করে দেব।
জিয়া ব্রিগেডের সভাপতি জাহিদ ইকবালের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সত্যিকার অর্থেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করি। কিন্তু অন্য ভুঁইফোড় সংগঠনের সঙ্গে যেভাবে আমাদের সংগঠন জিয়া ব্রিগেডকে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে তাতে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা দলের দুঃসময়ে বিএনপির জন্য কাজ করেছি। এখন দলের পক্ষ থেকে যে নোটিস দেয়া হয়েছে তাতে আমাদের দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কিছু বলার নেই।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, বিএনপি সমর্থক কিছু সংগঠন অনেক আগে থেকেই ছিল। তারা বিভিন্ন সময়ে আলোচনাসভা, সেমিনার ও মতবিনিময় সভা করে থাকে। তবে ইদানীং কিছু সংগঠনের অনিয়ম লক্ষ্য করায় এসব সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির কোন সম্পর্ক নেই বলে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এ ব্যাপারে আমার কোন মন্তব্য নেই। কিছু সংগঠনকে ভুঁইফোড় সংগঠন বলে কেন বিএনপির দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তা আমি বলতে পারব না।

No comments

Powered by Blogger.