টি২০ বিশ্বকাপের আকর্ষণ কোহলি by মোঃ সোহেল রানা

বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান কে? এমন প্রশ্ন ছুড়লে নিশ্চিত করে সবার আগে চলে আসবে বিরাট কোহলির নাম। টগবগে এই ভারতীয় যুবা ক্রিকেটের প্রতিটি ঘরানাতেই সমানে ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষের বোলারদের শাসন করে চলেছেন।


মঙ্গলবার শ্রীলঙ্কায় শুরু হওয়া চতুর্থ টি২০ বিশ্বকাপও হয়ত কোহলি আলোয় আলোকিত হতে চলেছে। প্রস্তুতি ম্যাচের পারফরমেন্স অন্তত সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে। গত সোমবার বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ প্রস্তুতি ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোহলি খেলেন ৭৫ রানের হার না মানা অনবদ্য ইনিংস। ৪৭ বলে সাতটি চার ও দুই ছক্কায় ঝলমলে ইনিংসটি সাজান ভারতীয় তারকা। তবে তাঁর আপসোস, কামরান আকমলের অপরাজিত ৯২ রানের ঝড়ো ইনিংসে হার মানে ভারত।
ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের গৌরবময় প্রায় সব রেকর্ডই শচীন টেন্ডুলকরের ঝুলিতে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গত মার্চে এশিয়া কাপেই গড়েন ‘সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি’র অনন্য কীর্তিগাথা। এটি ছাড়াও ভারতীয় ক্রিকেট ঈশ্বরের আরও যেসব গৌরবময় রেকর্ড রয়েছে তা নাকি চিরকাল অটুট থাকার সম্ভাবনাই বেশি! এর কারণ হিসেবে ক্রিকেট বোদ্ধারা বলে থাকেন, রেকর্ড ভাঙ্গার মতো তেমন কারোরই দেখা মেলেনি এখন পর্যন্ত! কিন্তু সম্প্রতি বিরাট কোহলি নামের এক টগবগে যুবকের অবিশ্বাস্য ব্যাটিং সবার ভাবনাকেই অন্য স্রোতে ভাসাতে বাধ্য করেছে। ধারাবাহিকভাবে কোহলির ব্যাটিং ঝলক দেখে অনেকেই ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন, ‘আগামীর শচীন কোহলি’। তাদের এমন বলা যে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের তা কিন্তু নয়। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট ডাম্বুলায় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওয়ানডে অভিষেক হওয়ার পর অবিশ্বাস্য ধারাবাহিক পারফরমেন্স প্রদর্শন করে চলেছেন ২৩ বছর বয়সী দিল্লীর তারকা। অভিষেকের পর প্রতিটি মৌসুমেই যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পণ করেছেন। চলতি বছরটাও কোহলির জন্য কাটছে সাফল্যে ভরপুর।
গত মার্চে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া এশিয়া কাপের কথাই ধরুন। কি অবিশ্বাস্য ঢংয়েই না ব্যাটিং করেন কোহলি। নিজ দেশ ভারত ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হলেও তিনটি ম্যাচের দু’টিতেই শতক হাঁকান ৫ নবেম্বর ১৯৮৮ সালে জন্ম নেয়া কোহলি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচে করেন অর্ধশতক। তবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের রান পাহাড় টপকাতে কোহলি যে বিস্ফোরক ব্যাটিং করেছিলেন তার তুলনা হয় না। তাঁর ক্যারিয়ারসেরা অনবদ্য ১৮৩ রানের কল্যাণেই পাকিস্তানের ৩২৯ রান টপক দুর্দান্ত জয় পেয়েছিল ভারত। সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত রয়েছে সাম্প্রতিক সময়েও। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট ও টি০ সিরিজে ব্যাট হাতে ছিলেন সবচেয়ে সফল। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচের একমাত্র ইনিংসে করেন ৫৮ রান। ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত শেষ টেস্টের দুই ইনিংসে করেন যথাক্রমে ১০৩ ও হার না মানা ৫১ রান। এরপর চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত টি২০ ম্যাচে খেলেন ম্যাচজয়ী ৭০ রানের অনবদ্য ইনিংস। এর আগে গত ৭ আগস্ট পাল্লেকেলেতে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সর্বশেষ ওয়ানডেতে করেন ৬৮ রান। সবমিলিয়ে ধারাবাহিকতার মূর্ত প্রতীক যেন কোহলি। ক্যারিয়ারের উঠতি সময়েই কোহলি যেভাবে নিজেকে নিংড়ে দিচ্ছেন তা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগতে বাধ্য। বয়স মাত্র ২৩। খেলেছেন ৯০ ওয়ানডে। অথচ এরই মধ্যে নিজের নামের পাশে যোগ করেছেন ১৩টি সেঞ্চুরি ও ২১টি হাফসেঞ্চুরি। ৫১.৮১ গড়ে রান ৩৮৮৬। একশ’র কম ম্যাচ খেলে এত সেঞ্চুরি ও রান অন্য কারোর আছে কিনা তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়! কোহলি অনেক আগে যারা ক্যারিয়ার শুরু করেছেন, অনেক ম্যাচ বেশি ও লম্বা সময় ধরে খেলছেন তাদেরও কোহলির চেয়ে সেঞ্চুরিসংখ্যা কম। শ্রীলঙ্কার কুমার সাঙ্গাকারার মোট ওয়ানডে শতক ১৪টি। এর মধ্যে তিন নম্বরে ১১টি। এই সেঞ্চুরি করতে সাবেক লঙ্কান অধিনায়ক ম্যাচ খেলেছেন ৩৩৩টি। ভারতের বীরেন্দর শেবাগ ২৪৯ ওয়ানডেতে ১৫টি ও একই দেশের গৌতম গাম্ভীর ১৩৯ ম্যাচে করেছেন ১১টি সেঞ্চুরি। কোহলি যে কতটা অপ্রতিরোধ্য তা একজনের সঙ্গে তুলনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। একালের ব্র্যাডম্যান শচীন টেন্ডুলকরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শুরুর সঙ্গে কোহলির ওয়ানডে ক্যারিয়ারের মিল খুঁজতে গেলে আপনি আঁতকে উঠতে বাধ্য। সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান শচীন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ৭৮ ম্যাচে ছিলেন সেঞ্চুরিবঞ্চিত! ১৯৮৯ সালে অভিষেক হওয়া শচীন পাঁচ বছর পর ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে নিজের ৭৯তম ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন। অথচ এখন পর্যন্ত মাত্র নব্বই ওয়ানডে খেলেই কোহলি করেছেন ১৩ সেঞ্চুরি। দুর্দান্ত এই সাফল্যের পথে বাংলাদেশের মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামও কোহলিকে দিয়ে চলেছে দু’হাত ভরে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপে শেরেবাংলায় ওয়ানডে ইতিহাসের ব্যক্তিগত ১২তম সেরা ইনিংস খেলার পর মিরপুরকে প্রিয় মাঠ হিসেবে আখ্যায়িত করেন দিল্লির তারকা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ারসেরা ১৮৩ রান করার পর সংবাদ সম্মেলনে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে প্রিয় মাঠ হিসেবে অভিহিত করেন কোহলি। মিরপুরে কোহলির ব্যাট হাতে পরিসংখ্যান দেখলে আপনার দু’চোখ তৃপ্তিতে ভরে যেতে বাধ্য! মিরপুরে কোহলি এ পর্যন্ত খেলেছেন ৯টি ওয়ানডে। এর চারটিতে করেছেন সেঞ্চুরি, তিনটিতে হাফসেঞ্চুরি। ১২২ গড়ে রান ৭৩২। মিরপুরে অবশ্য ১৬৩৭ রান করে সবার উপরে রয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার বাংলাদেশের শাকিব আল হাসান। কিন্তু এজন্য সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ককে খেলতে হয়েছে ৪৯টি ম্যাচ। অবশ্য পাঁচ গুণেরও বেশি ম্যাচ খেলে কোহলির চেয়ে সেঞ্চুরিসংখ্যা কম শাকিবের। মিরপুরে শাকিবের সেঞ্চুরি ২টি ও হাফসেঞ্চুরি ১৪টি। ভারতের আগামীর কা-ারীর এশিয়া কাপে ১৮৩ রানের ইনিংসটি ওয়ানডেতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেকোন ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। আগে রেকর্ডটি ছিল ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ব্রায়ান লারার। ২০০৫ সালে এ্যাডিলেডে লারা খেলেছিলেন ১৫৬ রানের ইনিংস। যে মিরপুর উজাড় করে দিয়েছে কোহলিকে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তো হবেনই। তাই তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে কোহলি অকপটে বলেছিলেন, শেরেবাংলা স্টেডিয়াম আমার খুব প্রিয় একটি মাঠ। এখানে দ্বিতীয় ইনিংসে বল খুব সহজে ব্যাটে আসে। আমার খেলতে কোন সমস্যা হয়নি। অনবদ্য ইনিংসটি খেলার পর সতীর্থ শচীন ও শেবাগের দু’ শ’ রানে দৃষ্টি ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে কোহলি বলেছিলেন, আমি বল অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করেছি। দ্বিশতকের কোন চিন্তা মাথায় আসেনি। কোহলিতে পিষ্ট হওয়ার পর সে সময়ের প্রতিপক্ষ অধিনায়ক মিসবাহ-উল হকও তার প্রশংসায় মেতে ওঠেন।

No comments

Powered by Blogger.