আলোকিত রবিন ভ্যান পার্সি... by ফারজানা আক্তার সাথী

হতে পারতেন চিত্রশিল্পী কিংবা ভাস্কর। কিন্তু তা হয়ে ওঠা হয়নি। বাবা-মায়ের পথে না হেঁটে হয়েছেন নিপুণ ফুটবলশিল্পী। তুলির আঁচর ক্যানভাসে নয়, পরশ বুলাচ্ছেন সবুজ গালিচায়। গানার শিবিরে যে ছিলেন ভরসার মূর্ত প্রতীক, সেই রবিন ভ্যান পার্সি এখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তুরুপের তাস।


আর্সেনালের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কের ছেদ টেনে ওল্ড ট্রাফোর্ডে বেশ উজ্জ্বলই তারকা এই ডাচ স্ট্রাইকার। গোলের পর গোল করে দলকে জেতাচ্ছেন, সঙ্গে রেডডেভিলস শিবিরে হয়ে উঠছেন আস্থার প্রতীক।
যদিও নতুন ক্লাবে ভ্যান পার্সির শুরুটা হার দিয়েই। মৌসুমের প্রথম লীগ ম্যাচে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হেরে গিয়েছিল এভারটনের সঙ্গে ১-০ গোলে। অনেকটা মাথা নিচু করেই মাঠ ছেড়েছিলেন ভ্যান পার্সি। তবে পরের ম্যাচেই ফুলহ্যামের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠেন তিনি। গোল দিয়ে ঘরের মাঠ ওল্ড ট্রাফোর্ডে অভিষেক হয় তাঁর। ১০ মিনিটে তাঁর করা গোলে ম্যাচে সমতা এনেছিলেন ম্যানইউ। শেষ পর্যন্ত ফার্গুসন বাহিনী ম্যাচ জেতে ৩-২ গোলে। পরের ম্যাচেই আসল চমক দেখান গত মৌসুমে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পাওয়া পার্সি। সাউদাম্পটনের বিরুদ্ধে করে ফেলেন নতুন মৌসুমের প্রথম হ্যাটট্রিক। তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যাচ জেতে ৩-২ ব্যবধানে। লীগের চতুর্থ ম্যাচে ম্যানইউ বড় জয় পায় উইগান এ্যাথলেটিকের বিরুদ্ধে (৪-০)। তবে এ ম্যাচে গোল পাননি পার্সি। কিন্তু স্ট্রাইক রেট শতভাগ। ম্যানইউর হয়ে চারটি ম্যাচ খেলে তাঁর গোল ৪টি। ইনজুরিতে ওয়েন রুনি। এরই ফাঁকে হার্নান্দেজের সঙ্গে পার্সির জুটি জমেছে বেশ। তবে রুনি ফিরে এলেও পার্সি থাকবেন তাঁর নিজ জায়গাতেই। অথচ একটা সময় ছিল আর্সেনাল মানেই ভ্যান পার্সি। ৮ বছর কাটিয়েছেন গানার শিবিরে রীতিমতো তারকা হয়ে।
মা জশে রাস ছিলেন চিত্রশিল্পী। বাবা বব ছিলেন ভাস্কর। কিন্তু এসব পথে হাঁটেননি পার্সি। ফুটবলের সঙ্গে তাঁর প্রেম শৈশব থেকেই। রাস্তায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে খেলতেই ফুটবলকে ভাল লাগা। ছোট থেকেই ফুটবলে তাঁর প্রতিভা ছাপ নজরে আসে সবার। আর সে কারণে মাত্র চার বছর বয়সেই তাঁর জায়গা হয়ে রটারডামের এসবিভি এক্সেলসিওরের যুব একাডেমীতে। কিন্তু এখানে তাঁর স্থায়িত্ব ছিল মাত্র এক বছর। বাবা তাঁকে ভর্তি করান ফেইনুর্ডের যুব প্রকল্পে। এখানেও বেশিদিন নয়। রব ওঠে এক্সেলসিওরের কোচের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিল পার্সির মায়ের। আর সে কারণেই আবারও ক্লাব পরিবর্তন। এরপর পারিবারিকভাবে একটি ধাক্কা খায় কিশোর পার্সি। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বাবা-মার।
তবে মায়ের কাছে না গিয়ে পার্সির জীবন শুরু হয় বাবার ছায়ায়। ফিরে আসেন আবারও এক্সেলসিওরেতে। এরপর ১৯৯৯ সালে আবার ফেইনুর্ডে। বছর দুয়েক পর মূল দলে অভিষেক। এখানে কাটিয়েছেন বছরতিনেক। ৬১ ম্যাচে করেছেন ১৫ গোল। এরপর ২০০৪ সালে পাড়ি জমান ইংল্যান্ড, ওয়েঙ্গারের শিষ্যরূপে। লেফট উইঙ্গার হিসাবে শুরু তাঁর। দুর্দান্ত ড্রিবলিং আর ট্যালেন্ডেট স্ট্রাইকারের আভা পার্সির বড় গুণ, বুঝতে পেরেছিলেন আর্সেনাল কোচ প্রথম থেকেই। ডেনিশ বারগক্যাম্পের রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে আর্সেনালে আসা পার্সি বছরখানেকের মধ্যেই জুটি গড়ে তোলেন ফরাসী স্ট্রাইকার থিয়েরি অঁরির সঙ্গে। দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসাবে নতুন পজিশনে বেশ ভালই নৈপুণ্য দেখাতে শুরু করেন তিনি। তবে ইমানুয়েল আদেবায়র ও অঁরির বিদায়ের পর মূল স্ট্রাইকার হিসাবে দলে জায়গা পোক্ত করেন পার্সি। আর বছরখানেক আগে স্পেনিয়ার্ড তারকা চেস ফ্যাব্রিগাস শৈশবের ক্লাব বার্সিলোনাতে গেলে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব গড়ায় পার্সির ওপর। অধিনায়কত্বের চাপ সঙ্গে স্ট্রাইকারের দুরূহ কাজটি বেশ ভালই সামলে নেন তিনি। অধিনায়ক হওয়ার পরই পার্সির খেলার ধার যেন আরও বেড়ে যায়। ম্যাচের পর ম্যাচ গোল পাওয়াটা যেন হয়ে যায় ডালভাত।
তবে আর্সেনালে ভাল খেলাটা যেন অসার হয়ে পড়ে। কারণ শিরোপা আসছিল না সেই অনুপাতে। অবশেষে শিরোপা জয়ের কারিগর স্যার আলেক্স ফার্গুসনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন পার্সি। তারকা থেকে এখন মহাতারকায় পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় তিনি।
তারকা খেলোয়াড়ের তকমা গায়ে লাগলেও ক্যারিযারে কালো ছায়াও কয়েকবার লেপ্টে গিয়েছিল তাঁর। শৈশব থেকেই তার শুরু। ভদ্রতার লেশমাত্র ছিল না তাঁর মধ্যে। অসদাচরণের জন্য কখনও কখনও ক্লাস থেকেই তাঁকে বের করে দেয়া হতো। আর সে কারণে প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দেয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল তাঁর। তবে অনেকের ধারণা, অল্প বয়সে বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ির ঘটনা প্রভাব পড়েছিল শিশু মনের ওপর। সে কারণে বদমেজাজী স্বভাবটা বিগড়ে গিয়েছিল আগে থেকেই। ফলে ক্লাবের কোচদের সঙ্গে তাঁর ঝগড়াঝাটি তারই বহির্প্রকাশ। তবে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার বছরখানেকের মধ্যে বড় ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন পার্সি। যা তাঁর ক্যারিয়ারে কালো অধ্যায়। ২০০৬ সালে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগ আনেন সান্দ্রা ক্রিগসম্যান নামের এক মহিলা। তাঁর মতে, এক হোটেলে তাকে ধর্ষণ করেছিল পার্সি।
এমন অভিযোগ আনার সঙ্গে সঙ্গেই পার্সিকে গ্রেফতার করে ডাচ পুলিশ। কারাগারে থাকতে হয়েছিল ১৪ দিন। পরে এই অভিযোগে ভিত্তি না পাওয়া ছেড়ে দেয়া হয় তাঁকে। তবে নজরদারিতে থাকেন পরের সাত মাস। এখন সেসব শুধু স্মৃতি। দীর্ঘদিনের বান্ধবী বুশরাকে নিয়ে সুখের ঘর পার্সির। দুই ছেলেমেয়েও আছে তাঁদের। ছেলে শাকিল আর মেয়ে দিনা লায়লাকে সুখী রাখার চেষ্টাই পার্সি দম্পতির। স্ত্রী বুশরা মরোক্কান বংশোদ্ভূত, মুসলিম আদর্শে বিশ্বাসী। গুঞ্জন আছে বুশরার পথ ধরে পার্সিও নাকি ধর্মান্তরিত হয়েছেন। যদিও এ বিষয় নিয়ে কখনও মুখ খোলেননি পার্সি। তাঁর মতে, মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে সফল হতে হলে, সুখ থাকা দরকার নিজ ঘরেই। আর সেই শান্তি আছে পার্সির পরিবারে। জীবনকে খুব কঠিন না করে সহজ পন্থায় দেখেন বলেই এমন সুখের রহস্য।

No comments

Powered by Blogger.