ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ নিয়ে উপাচার্যদের এক মতবিনিময় সভা হয়। হালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থির অবস্থা, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় আলোচনায় স্থান পায়। সভায় বেশির ভাগ উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অস্থির অবস্থার


একটি বড় কারণ হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠন কর্তৃক ছাত্রদলের ওপর আক্রমণ ও নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে দায়ী করে জোরালো বক্তব্য দেন। শিক্ষামন্ত্রী তাঁদের সতর্ক থাকতে এবং কঠোরভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বডিকে কার্যকরী করার পরামর্শ দেন। উপাচার্যদের নিয়ে এ ধরনের বৈঠক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন; কিন্তু বৈঠক শুধু দোষারোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার দিকেও নির্দেশ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন অনেক। এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমেই দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা ছাড়া বাকিগুলো একেবারে খারাপ চলছে, তা বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতার কারণগুলো বহুবিধ। শুধু ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠনকে এককভাবে দায়ী করে আমরা সবাই এর দায় এড়াতে পারি না। হ্যাঁ, ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড এর জন্য দায়ী বটে; কিন্তু তারা কেন, কোন প্রক্রিয়ায়, কার পরামর্শে অস্থিরতা তৈরি করছে, তা অনেকের অজানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কাছে থেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমি বলতে পারি, ছাত্রলীগের অশান্ত আচরণের পেছনে তারা এককভাবে দায়ী নয়। পাঠক মনে করবেন না আমি লেখার মাধ্যমে ছাত্রলীগকে উসকে দিচ্ছি। সে ধরনের ইচ্ছা আমার নেই, তবে এই লেখার মাধ্যমে অনেক অজানা সত্য হয়তো বেরিয়ে আসবে, যা সমস্যা উত্তরণে হয়তো পথ দেখাতে পারবে।
বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠনের কোনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে আহ্বায়ক কমিটি কিংবা কমিটি ছাড়াই। নেতৃত্ব না থাকা কিংবা পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্ব না থাকার কারণে সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। কারণটি খুবই স্বাভাবিক। কোনো পদে না থাকলে নিজেকে শুধু কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে হয়। জবাবদিহিতা, দায়িত্বহীনতা, চেইন অব কমান্ড, নির্দেশ পালন করা বা দেওয়ার বালাই নেই। কে কাকে মান্য করবে, নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেবে_এ দোদুল্যমানতায় সবাই নেতা, আবার সবাই কর্মী। এমন মনোভাব নিজেদের মধ্যে কাজ করে। কমিটি হবে_এ আশায় নিজেদের স্থান পাকাপোক্ত করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি আর হয় না। গ্রুপগুলো থেকে যায় এবং পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত হয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি কেস হিসেবে এখানে উল্লেখ করতে পারি। গত সাড়ে তিন বছরে এখানে ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। একটি আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে সংগঠনটি চলছে। এদের মধ্যে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছে। এখানে সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ছোট-বড় অনেক গ্রুপ। একমাত্র কারণ পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকা। কমিটি হলে হয়তো গ্রুপিং কমে যাবে এবং একটি অস্থির আস্থা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব।
উপাচার্যদের কর্মকাণ্ড, তাঁদের একক ক্ষমতা প্রয়োগ ও মনোভাব কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অশান্ত করে তোলে। যখন তাঁদের কর্মকাণ্ড ও ক্ষমতার সঙ্গে শিক্ষক ও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন করা সম্ভব হয় না, তখন সমস্যা দেখা দেয়। আবার কখনো কখনো উপাচার্য, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত হয়ে ওঠে। এখানে শুরুতে সাধারণ ছাত্রছাত্রী কিংবা ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা নগণ্য থাকে। যেমন_বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার জন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও ছাত্রসংগঠনগুলো যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনসহ অন্যরা। ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠনের ছেলেরা রেজিস্ট্রারের দরজায় লাথি মেরে অন্যায় করেছে; কিন্তু বুয়েট দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পেছনে ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠনকে কোনোভাবেই এককভাবে দায়ী করা যায় না। তেমনিভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনকে দায়ী করতে পারি; কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ও দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার জন্য আরো অনেকে সমভাবে দায়ী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একক ক্ষমতাবলে এডহক ভিত্তিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি শিক্ষকও নিয়োগ করতে পারেন। তিনি এ ক্ষমতা ভালোভাবে প্রয়োগ করে থাকেন। নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে অনেককে নিয়োগ দেন। আবার কখনো বা নিয়মিত নিয়োগপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। নিয়মিত নিয়োগপ্রক্রিয়ায় উপাচার্যর ক্ষমতাও অনেকটা একক। নিয়োগ বোর্ডের অন্য সদস্যরা উপাচার্যকে সমর্থন দিয়ে যান। আবার কখনো এখানে ভাগাভাগি হয়। ভাগ যখন আদৌ কেউ না পান কিংবা কম পান, তখন শিক্ষক-উপাচার্য, কর্মচারী-উপাচার্য, কর্মকর্তা-উপাচার্য_এমনকি ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠন-উপাচার্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যার পরিণতি ভয়ানক রূপ ধারণ করে। অতিসম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্তৃক ব্যাপক তাণ্ডব চালানো ভাগ না পাওয়ার জন্য হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। দ্বন্দ্ব যে শুধু ভাগাভাগির জন্য হয় তা নয়, নিজের মধ্যকার মতাদর্শ, আদর্শ, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস প্রভৃতি কারণেও হয়ে থাকে, তবে তার পরিমাণ নিতান্তই কম।
কখনো কখনো শিক্ষকরা ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠনের বিভিন্ন উপদলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। ব্যাপক কোনো ক্ষমতা না থাকায় নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে কেউ কেউ প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে থেকে কিংবা বাইরে থেকেও নিজেকে ক্ষমতাধর ভাবা শুরু করেন। নিজেকে ও নিজের অবস্থান জাহির করার জন্য ব্যবহার করেন ছাত্রসংগঠন। পেছন থেকে একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। সংগঠনগুলোও নিজ গ্রুপকে শক্তিশালী করার জন্য শিক্ষকদের ব্যবহার করে। ফলে গ্রুপিং হয় পাকাপোক্ত। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক সহকর্মীদের মধ্যেও ছাত্রসংগঠনগুলোর মতো বিভিন্ন উপদল তৈরি হয়েছে। এই উপদলগুলো সিনিয়র শিক্ষকদের সাহায্যে আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করে। ব্যাপারটি হয়তো অনেকের অজানা থাকতে পারে। নিয়োগ, প্রশাসনিক পদ গ্রহণ, ক্ষমতা প্রয়োগ, নিজের মতাদর্শের যথেচ্ছ ব্যবহার, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জড়িয়ে পড়া বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করে লেখাটির ইতি টানব। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ছাত্রসংগঠনের ওপর রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালোভাবে চলার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। আমরা যদিও বলি, বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান; কিন্তু স্বায়ত্তশাসন থাকা সত্ত্বেও এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাব থাকে। কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটের পরিবর্তে ভিন্ন নামে রিজেন্ট বোর্ড রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বোর্ডের সদস্য থাকেন। এখানে তাঁরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পান, যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
অতিসম্প্রতি ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠনের আচরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, তবে আমার বিশ্বাস, কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে তারা এ কাজ করতে পারে না। লেখাটির মাধ্যমে অনেক কারণ এখানে উল্লেখ করলাম, যা ছাত্রসংগঠনগুলোর বিচ্যুতিমূলক আচরণের মূলে কাজ করে। আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সঠিক ও গণতান্ত্রিতভাবে নেতৃত্ব তৈরি করতে পারি, শিক্ষকরা ছাত্রদের সঠিক নির্দেশনা দিতে পারেন, সংগঠনের আদর্শ থেকে কেউ যদি বিচ্যুত না হয় ও নগ্ন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছাত্রসংগঠন তৈরি করতে পারি, তাহলে সঠিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালানা করা সহজ হবে। সমস্যার মূল কারণ অনুসন্ধান না করে ক্ষমতাসীন সহযোগী ছাত্রসংগঠনকে এককভাবে দায়ী করলে সমস্যাটি আমরা জিইয়ে রাখতে পারব; কিন্তু সমাধানের দিকে যেতে পারব না।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.