ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক-কেবল আশ্বাস নয়, বাস্তবে উন্নয়ন চাই

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রধানত নির্ভর করে সে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর। এ ক্ষেত্রে যোগাযোগ অবকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন তো দূরে থাক, বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর অবস্থার দিন দিন অবনতিই হচ্ছে। গতকালের কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে কেবল সড়ক ও জনপথ (সওজ)


অধিদপ্তরের অধীনেই কমপক্ষে চার হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার কাঠামোর অধীনে যেসব সড়ক রয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত_কোনোটাই হচ্ছে না। ফলে বহু সড়ক কার্যত চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে সময় যেমন বেশি লাগছে, দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত সরকারি হিসাব অনুযায়ী, আগের বছর সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে চার হাজার লোক মারা গেছে। তবে বেসরকারি হিসাবে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজারের বেশি। শুধু মৃত্যুই নয়, বিপর্যস্ত সড়কের কারণে প্রতিবছর নানাভাবে দেশের অপচয় বা ক্ষতি হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
আমাদের রাজনীতিবিদরা কথার ফানুস ছড়াতে বড় বেশি দক্ষ। আর তাতেই আমরা মোহিত হই এবং পরবর্তীকালে সেই ফানুস যখন বাতাসে মিলিয়ে যায়, তখন হতাশ হই। চট্টগ্রাম হচ্ছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। মন রাঙাতে বলা হয় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশের আমদানি-রপ্তানির বেশির ভাগই হয় এই বন্দর দিয়ে। গত বছরও এই বন্দর দিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছে। সেই চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সুগম করার কত না আশ্বাস আমরা শুনেছি! আগের এক যোগাযোগমন্ত্রী রেলপথে সুপারসনিক ট্রেন চালানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পরে সুপারসনিক থেকে নেমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডাবল লাইন তৈরির মাধ্যমে চার ঘণ্টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার গল্প শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কোনোটাই হয়নি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শুনে আসছি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। বর্তমান মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়। কথা ছিল, দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে। কিন্তু কাজের যে ধীরগতি, তাতে এই কাজ কবে শেষ হবে তা অতি দক্ষ গণিতবিদও হিসাব করে বলতে পারবেন না। ২০২০ সালে গিয়েও যদি দেখি কাজ চলছে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সড়ক-মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও নির্মাণকাজের অতি ধীরগতির পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও দলীয়করণের প্রভাব। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, নির্মাণকাজ শেষ না করেই অনেক ঠিকাদার অর্থ উঠিয়ে নেন। আবার অনেক ঠিকাদার কাজ শেষ করেও মাসের পর মাস, এমনকি খুশি করতে না পারলে বছরের পর বছরও বিল পান না। জানা গেছে, কেবল সওজ অধিদপ্তরের কাছে ঠিকাদারদের পাওনা রয়েছে ১৮৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৭৭ কোটি টাকা পাওনা হয়েছে মহাজোট সরকারের গত সাড়ে তিন বছরে। ভালোভাবে কাজ করার বদলে যেনতেন প্রকারে কাজ শেষ করে ঊর্ধ্বতন মহলকে খুশি করতে এবং দ্রুত বিল তুলে নিতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
সড়ক-মহাসড়কের কাজ হয় রাষ্ট্রের তথা জনগণের অর্থে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য। জনগণের সরকার বা গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সেই অর্থের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এ পর্যন্ত কোনো সরকারের কাছ থেকেই আমরা সেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আন্তরিকতা পাইনি। অদূর-ভবিষ্যতে পাব কি?

No comments

Powered by Blogger.