ফের তত্ত্বাবধায়ক! by ইলিয়াস সরকার

আপাতদৃষ্টিতে আদালতের রায়ে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার চির অবসান হয়েছে মনে হলেও কার্যত তা হচ্ছে না। বস্তুত নতুনভাবে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের এখতিয়ার এখন সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। যদিও ওই সরকারে বিচার বিভাগকে না জড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আদালতের অভিমতে বলা হয়েছে, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদের দ্বারা গঠিত হইতে পারে।”

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের এ রায়ে একমত পোষণ করেছেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

এছাড়া বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। সাত বিচারপতির মধ্যে অপর বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেন। সুতরাং ৭ জনের মধ্যে চার বিচারপতি নতুন আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দুইজন বিচারপতি আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছেন।

বস্তুত, ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট ১৩তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। এর ২০ দিন পরই জাতীয় সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অবসান ঘটায়। আর গত রোববার রাতে তত্ত্বাবধায়কের কফিনে আপাতত শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

রোববার প্রকাশিত রায়ের ৩৩৮ পৃষ্ঠায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক লিখেছেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ অ্যামিকাস কিউরিগণ কোনো না কোনো আকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখিবার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের আশঙ্কা, নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাঁহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাঁহাদের আশঙ্কা, আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না। যদিও বিতর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন ১৯৯৬ কে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হহইয়াছে এবং ইহা অবশ্যই অবৈধ। তবুও এইরূপ আশঙ্কার কারণে সহস্র বৎসরের পুরাতন Latin Maxim, যেমন, Id Quod Alias Non Est Licitum, Necessitas Licitum Facit  (That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful), Salus
Populi  Est  Suprema  Lex  (Safety  of  the  people  is  the  supreme  law)  Ges  Salus Republicae Est Suprema Lex (Safety of the State is the Supreme Law) ইহার সহায়তা লইতে হইল। উপরোক্ত  নীতিসমূহের   আলোকে   তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধু পরবর্তী দুইটি সাধারণ নির্বাচনের  ক্ষেত্রে  থাকিবে কি না  সে  সম্বন্ধে  চূড়ান্ত  সিদ্ধান্ত  শুধু  জনগণের  প্রতিনিধি  জাতীয়  সংসদ লইতে পারে। উক্ত  সময়ের  মধ্যে  সংশ্লিষ্ট  সকলেই  নিজ  নিজ  কর্তব্য  সঠিকরূপে পালন  করিতে  সম্পূর্ণ  সজাগ  ও  পরিপূর্ণ  দায়িত্বশীল  হইবেন  বলিয়া  আশা করা যায়। এইরূপ  অসাধারণ  পরিস্থিতির  কারণে  উপরোক্ত  সহস্র  বৎসরের পুরাতন Latin Maxim প্রয়োগ করতঃ বিতর্কিত সংবিধান  (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন,  ১৯৯৬,  অবৈধ  হওয়া  সত্বেও  আগামী  দশম  ও  একাদশ  সর্বোচ্চ এই দুইটি  সাধারণ নির্বাচন জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হইতে পারে। তবে জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ও আপীল বিভাগের বিচারপতিগণকে বাদ দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ণ করিতে পারে, কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তাহাদিগকে সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়। বরঞ্চ  তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে, কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা,  বিচার  বিভাগের  স্বাধীনতা  সংবিধানের basic  structure  এবং  এই  রায়ে  উক্ত বিষয়গুলির  উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে।”

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের এ রায়ে একমত পোষণ করেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

এছাড়া বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা (ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। সাত বিচারপতির মধ্যে অপর বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেন। সুতরাং ৭ জনের মধ্যে চার বিচারপতি নতুন আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দুইজন বিচারপতি আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়ে একশ’ ৭৬ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন  বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা।

এ রায়ে তিনি লিখেছেন, “অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের অংশ এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারই ফসল। অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে সংসদের সত্যিকারের বৈধতা থাকবে না। এবং এ ধরনের সংসদে জনগণের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। যদি সংসদ সদস্যরা অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত না হন তাহলে সে সংসদের প্রতি আমাদের বিশেষ ভালোবাসা থাকা উচিত হবে না। সংবিধান অনুযায়ী তিনশ’ সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে সংসদ গঠিত এবং সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই সে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। যদি অর্থ, সন্ত্রাস এবং সরকারি মেশিনারি ব্যবহার করে কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তাহলে তাকে জনগণের প্রতিনিধি বলা যায় না। এ ধরনের সংসদের কথা আমাদের সংবিধানে বলা হয়নি এবং এ ধরনের সংসদ আমাদের পূর্ব-পুরুষ এবং শহীদদের স্বপ্নের ধারক হতে পারে না, যারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবনদান করেছেন। আমাদের সংবিধানে বর্ণিত রাজনৈতিক দল ভারতীয় সংবিধানের রাজনৈতিক দলের মত ক্ষমতাবান নয়। তবে সংবিধান এবং গণপ্রতিনিধি আদেশে বর্ণিত রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগণ থেকে রাজনৈতিক দলকে আলাদা করা যায় না। এ কারণে রাজনৈতিক দলের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর (সরকার-বিরোধীদল) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঐক্যমতকে অবজ্ঞা করা উচিত হবে না। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের বিধান সংবিধানে পূর্বেই ছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে সরকার গঠনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এটি করা হয়েছে। এতে গণতন্ত্রকে কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়নি। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে অনির্বাচিত ব্যক্তির প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার বিধানে কোন সাংবিধানিক সমস্যা নেই। বর্তমানেও দু’জন মন্ত্রী এবং একজন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন যারা নির্বাচিত নন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে বহাল থাকেন, যিনি নির্বাচিত, তাই রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র হারানোর সুযোগ নেই।”

কেবল বিচারপতি নন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়াতেও পাওয়া যাচ্ছে যে কোন ফরমেটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা।

তবে এ জন্য ফের সংবিধান সংশোধন করতে হবে বলে মত দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

তিনি বলেন, “প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের (নির্বাচনকালীন সরকার ) হেড কে হবেন? আর ওই ব্যক্তি যদি নির্বাচিত না হন, তাহলে কি হবে। এর উত্তরে বলা যায়, উভয় পক্ষ একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে সিলেকশন করে কোনো আসন থেকে নির্বাচিত করে আনতে পারে। তখন তো আর কোনো সমস্যা থাকে না। যেমন ভারতে মনমোহনকে আসাম থেকে নির্বাচিত করে আনা হয়েছিলো।”

সংখ্যাগরিষ্ঠের কারণে এ সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেলেও আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার করবার জন্য এখনো সুযোগ রয়েছে। এ রায়ে একটি দিক নির্দেশনা আছে। সিডিউল ঘোষণা করার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। আর এটা হতে পারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে। সরকার ও বিরোধী দলে নির্বাচিত ব্যক্তি আছেন। সুতরাং কোনো সমস্যা আছে বলে মনে করি না। এখন রাজনীতিবিদরাই এর সমাধান করবেন। এটা তাদেরই দায়িত্ব।”

No comments

Powered by Blogger.