সময়ের প্রতিধ্বনি-মন্ত্রিসভার রং বদল, গুম-আতঙ্ক ও বড় ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা by মোস্তফা কামাল

আমন্ত্রণ পেয়েও মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। বিষয়টা রহস্যজনক এবং এর মধ্যে বড় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। শেষ মুহূর্তে মন্ত্রিসভার রদবদল করতে গিয়ে বেশ হোঁচট খেয়েছে সরকার।


বিষয়টিকে সাদামাটাভাবে দেখার কোনো উপায় নেই।
নবনিযুক্ত মন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেই ফেললেন, মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করে সন্ন্যাসী হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম বিজ্ঞ ও প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ। তার পরও কেন তিনি মন্ত্রিত্ব নিতে অনীহা প্রকাশ করলেন? তাহলে কি তিনি বর্তমান সরকারের বিদায় ঘণ্টার বার্তা আগেই পেয়ে গেছেন?
আমরা জানি, ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনাপ্রবাহে তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আবদুল জলিল, সাবের হোসেন চৌধুরী, আখতারুজ্জামান, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরসহ অনেকেই দলে পুরোপুরি কোণঠাসা। দলে থেকেও তাঁরা নেই। নীতিনির্ধারণী কোনো বৈঠকেই তাঁদের ডাকা কিংবা রাখা হয় না। বিগত সাড়ে তিন বছরে সরকার তাঁদের কোনো ধরনের পরামর্শও নেয়নি। বরং সংস্কারপন্থী বলে যতটা সম্ভব চাপে রেখেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনভিজ্ঞ নেতারা বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছেন। মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রেও উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এ কারণে মন্ত্রিসভা নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। তার পরও অভিজ্ঞ ও প্রবীণ নেতারা দলে ও সরকারে গুরুত্বহীন থেকেছেন। শেখ হাসিনার এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে দলে আছেন বলেই তাঁরা হেভিওয়েট নেতা। না থাকলে কিছুই না। কাজেই কেউ না থাকলেও শেখ হাসিনা একাই দলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন। তা ছাড়া তিনি এও ভাবেন, তাঁর চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার আবার কে? এ কারণে বড় নেতারাও তাঁর কাছে পাত্তা পান না। সেই অভিমান থেকেই হয়তো তোফায়েল মন্ত্রিত্ব নিতে চাননি। এ জন্য তোফায়েলকে বড় কোনো শাস্তি পেতে হবে কি না জানি না। তবে আগামী নির্বাচনে যদি তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাশেদ খান মেনন মন্ত্রী হওয়ার লোভ সংবরণ করলেন কিভাবে? তিনি তো প্রস্তুতই ছিলেন! তা ছাড়া ভবিষ্যতে মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসবে কি না সন্দেহ। তার পরও শেষ মুহূর্তে কেন পার্টির পলিটব্যুরোর একটি বৈঠক ডেকে অন্য রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? আমরা তো জানি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মেনন সাহেবের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো। বিগত সাড়ে তিন বছরে সরকার বিব্রত হতে পারে এমন কোনো কাজ তিনি করেননি। বরং সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলেন। হঠাৎ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার নেপথ্যের কারণ কী?
মেনন সাহেব বলেছেন, মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ যথাযথ নিয়মে হয়নি এবং পৃথিবীর সভ্য দেশে এ রকম রেওয়াজ আছে কি না জানি না। এর জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি মেনন সাহেবকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালের বই পড়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারে মেনন সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে, এ বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণা নেই। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রক্রিয়াটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। সাধারণত তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। সব গণতান্ত্রিক দেশেই এই রীতি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই রীতিই চালু আছে। এ কারণে যদি মেনন সাহেব মন্ত্রিসভায় যোগ না দিয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হবে, তাঁর 'নসিব' খারাপ।
সরকারের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সরকারকে বিব্রত করতে এবং ব্যক্তিগতভাবে বাহবা কুড়ানোর জন্যই তাঁরা মন্ত্রিত্ব নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এতে সাময়িকভাবে তাঁদের ভাবমূর্তি চাঙ্গা হলেও অদূর ভবিষ্যতে এর খেসারতও দিতে হতে পারে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কথায় সে রকমই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তোফায়েল আহমেদের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেছেন, তোফায়েল সাহেবের মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়া বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। মন্ত্রিত্ব না নিয়ে তিনি দলকে ছোট ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। একই সঙ্গে দলের সিদ্ধান্তকে অপমান করেছেন। এ পরিস্থিতিতে তোফায়েল আহমেদের অবস্থান পরিষ্কার করা খুবই জরুরি।
অবশ্য গত সোমবার তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করে পাল্টা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এসব যুক্তির মধ্যে সরকারের সঙ্গে তাঁদের 'গ্যাপ' সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। খুব সহসাই যে ব্যাপারটা মিটে যাবে, তা নয়। বরং তাঁদের নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকবে।
এদিকে মন্ত্রিসভার রদবদল নাকি রং বদল, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। অনেকেই বলছেন, এটা স্রেফ রং বদল এবং এক ধরনের আইওয়াশ। এই মন্ত্রিসভা দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা যাবে না। শেষ মুহূর্তেও যদি অদক্ষদের বাদ দিয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞদের নিয়ে আরো ছোট আকারের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা যেত, তাহলে সরকারের শেষরক্ষা হতো। মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে কেবল রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ছোট দেশের এত বড় মন্ত্রিসভার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
দেশের আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সরকার বিগত সাড়ে তিন বছরই ব্যাপক চাপে ছিল। তার মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বেফাঁস কথাবার্তার কারণে সরকারকে বেশ বিব্রত হতে হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য যে প্রশাসনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন, তার কোনোটিই সাহারা খাতুনের ছিল না। ফলে তিনি পুরোপুরি আমলানির্ভর ছিলেন। দলীয় ক্যাডার বাহিনী ও অতি দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়েও তিনি বিপদে ছিলেন। সংগত কারণেই তিনি কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাঁর সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে অসাধু চক্র।
নবনিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি দক্ষ আমলা ছিলেন। তিনি যদি আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে আন্তরিক হন, তাহলে বর্তমান অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে তাঁকে দলীয় ক্যাডার ও অতি দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের সতর্কতার সঙ্গে হ্যান্ডেল করতে হবে। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিলে ড. কামাল হোসেনের মতো সবার মনেই শঙ্কা থাকবে গুম হয়ে যাওয়ার। সেই শঙ্কা দূর করতে হলে দলীয় বিবেচনার ঊধর্ে্ব উঠে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেটা নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হবে কি না সে সংশয়ও আমাদের রয়েছে।
নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের কারো কারো সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু এই অল্প সময়ে তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন কি না বলা মুশকিল। তা ছাড়া এ এইচ মাহমুদ আলী ও মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ সারা জীবন পররাষ্ট্র সার্ভিসে চাকরি করেছেন। কূটনীতিক হিসেবে তাঁরা উভয়েই সফল ছিলেন। তাঁদের একজনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলে হয়তো ভালো করতেন। তাঁদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারতেন।
বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছেন। বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে ধরনের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা থাকা দরকার, তা তাঁর নেই। তিনি তাঁর মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের চেয়ে বিদেশ সফরে বেশি উৎসাহী। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক দেশগুলো অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকে। গুরুত্বের দিক থেকেও প্রধানমন্ত্রীর পরই পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রীর অবস্থান। আমরা যদি দুটি বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশের দিকে তাকাই, তাহলেই আমাদের ধারণা স্পষ্ট হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্টলেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সে দেশের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। পরে একই দলের বারাক ওবামাকে সমর্থন করে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্বচ্ছ। আমেরিকান নীতি সম্পর্কেও তাঁর ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ একজন প্রবীণ ও বিচক্ষণ রাজনীতিক। সেই বিবেচনায় দীপু মনির অবস্থান কোথায়! শুধু অভিজ্ঞ পররাষ্ট্রসচিব ও পেশাদার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকলেই হয় না। একই সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দূরদৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন এবং অসম্ভব কৌশলী হতে হয়।
সরকার যা-ই বলুক, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ অনেকটা বন্ধুহীন। আমেরিকা ও ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বেশ অবনতি ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। চীন অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। ভারত এখনো আস্থায় রেখেছে বলে সরকার কিছুটা চাঙ্গা আছে। এই চাঙ্গাভাব কাটতেও বেশি সময় লাগবে না।
প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী একজন বিজ্ঞ মানুষ। কিন্তু তিনি দীর্ঘকাল দেশের বাইরে ছিলেন। এ দেশের মানুষের স্বার্থ ও আবেগের জায়গাটি তিনি ধরতে পারেননি। ফলে কোন দেশের সঙ্গে কী স্বার্থ, কী কৌশল নিয়ে অগ্রসর হলে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, তা তিনি বুঝতে পারেন না। তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রীকে সৎ পরামর্শই দিতে চান। কিন্তু তাঁর সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও তো মাথায় রাখতে হবে! এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া উচিত ছিল।
আমরা মনে করি, এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও চীনসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাবেক কূটনীতিক ও বিজ্ঞ রাজনীতিকদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা যেতে পারে। তাঁদের দায়িত্বই হবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কাজ করা। কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে বিভিন্ন দেশে পাঠানো যেতে পারে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.