নির্মম বাস্তবতার কাহিনীচিত্র-ঘেটুপুত্র কমলা by খন্দকার মো. জাকির

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ নির্মিত চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলা। ছবিটি নির্মাণের আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন আর ছবি বানাবেন না। একজন নির্মাতা এ রকম ঘোষণায় কতটা স্থির থাকতে পারতেন সেটা বলা মুশকিল। তবে হুমায়ূন আহমেদ বিচিত্র কল্পের মানুষ।
হয়তো তিনি তাঁর ঘোষণায় অটল থাকতেও পারতেন। তবে তাঁর সর্বশেষ ছবি হিসেবে বিচিত্র চিন্তার ফসল ঘেটুপুত্র কমলা। চিরাচরিত জমিদার চরিত্রকে এবার অন্যরূপে হাজির করতে একপাও পিছপা হননি তিনি। তাই তো ভুলতে যাওয়া এক ঘেটুপুত্রকে নিয়ে জমিদার চরিত্রকে তিনি তুলে ধরলেন তাঁর ক্যামেরায়।
গল্পের প্রেক্ষাপট প্রায় দেড়শ’ বছর আগের, ব্রিটিশ আমলের। সিনেমার শুরুতে ভয়েসওভারে সেই প্রেক্ষাপটের একটি সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হয়। তখনকার হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামের পটভূমিতে চলচ্চিত্রটির কাহিনী চিত্রিত। সে সময় জলসুখা গ্রামের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘেটুগান নামে নতুন গ্রামীণ সঙ্গীতধারা সৃষ্টি হয়েছিল। নতুন সেই সঙ্গীত ধারাতে মেয়েদের পোশাক পরে কিছু সুদর্শন সুন্দর মুখের কিশোরদের নাচগান করার রীতি চালু হয়। এই কিশোরদের আঞ্চলিক ভাষাতে ঘেটু নামে ডাকা হতো। নব এই সঙ্গীতধারাতে গান প্রচলিত সুরে কীর্তন করা হলেও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রভাব বেশ লক্ষণীয় ছিল। গ্রাম্য অঞ্চলের অতি জনপ্রিয় নতুন সঙ্গীত-রীতিতে নারী বেশধারী কিশোরদের উপস্থিতির কারণেই এর মধ্যে অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে। সমাজের বিত্তবানরা বিশেষ করে জমিদাররা এইসব কিশোরকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাবার জন্যে লালায়িত হতে শুরু করেন। একসময় সামাজিকভাবে বিষয়টা স্বীকৃতি পেয়ে যায়। হাওর অঞ্চলের জমিদার ও বিত্তবান শৌখিন মানুষরা বর্ষাকালে জলবন্দি সময়টায় কিছুদিনের জন্য হলেও ঘেটুপুত্রদের নিজের কাছে রাখবেন এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে বিবেচিত হতে থাকে। আর বিত্তবানদের স্ত্রীরা ঘেটুপুত্রদের দেখতেন সতীন হিসেবে। কমলা নামের এমনই এক ঘেটুপুত্রের গল্প নিয়েই হুমায়ূন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। ঘেটুগান বা ঘেটুপুত্র সম্পর্কে আদৌ কোন ধারণা বর্তমান প্রজন্মের কাছে আছে কিনা সে তথ্য জানা নেই। কারণ চলচ্চিত্রকার নিজেই এই গান বিলুপ্তির কথা বলেছেন। এবং সেই সাথে সেই কদর্য কুৎসিত গল্পের সমাপ্তির জন্য আনন্দও প্রকাশ করেছেন, যা সিনেমার পরিণতি দেখে সহজে অনুমেয়। ঘেটুপুত্র কমলা চলচ্চিত্র দেখতে বসে হুমায়ূন আহমেদের গল্প নিয়ে চিত্রিত ‘নিরন্তর’ ছবির কথা মনে পড়ে। সেখানে মা তার মেয়ের পেশা সম্পর্কে জেনেও কোন বিকার করেন না। কারণ বাস্তবতাকে নির্মম সত্য মেনে নিয়ে উপায়হীন-অসহায় পরিবারের হাল ধরার জন্য সে পেশার বিকল্প কোন পথ দেখতে পাই না। বরং মা মেয়েকে ক্লায়েন্টদের উপযোগী করে সাজিয়ে তোলেন। ঘেটুপুত্র কমলায় সেই চরিত্রের একই রূপ। তবে এটাও অজানা যে ঘেটু তার পুত্রকে নিজ হাতে জমিদারের মনোরঞ্জনের জন্য উপযোগী করে দিতেন। ঘেটুপুত্রের শিৎকার ধ্বনি পিতার কাছে কী এক বিচিত্র বাস্তবতাকে তুলে ধরে, সেটা ছবিটি না দেখলে বোধহয় বোঝানো যাবে না। জমিদারদের বিকৃত চরিত্র চরিতার্থ করার জন্য জমিদারের স্ত্রীও সে অন্যায় সয়ে যান দিনের পর দিন। স্বামীর বিকৃতির প্রতিবাদের পরিবর্তে নারীর চিরায়ত রূপকে তুলে ধরার চেষ্টায় মত্ত থাকেন তিনি। নির্যাতনের শিকার হয়েও অসহায় চরিত্রের কমলাকে কোন প্রকার প্রতিবাদী হতে দেখি না। এমনকি জমিদার শিশুকন্যার সাথে বন্ধুত্বটাও যেন তাকে আরও নিষ্প্রাণ করে। তার বাড়িতে থাকা বোনের কথা মনে করিয়ে তাকে দুর্বল করে তোলে। অবশেষে নির্মম বাস্তবতার বলি হিসেবে তাকে প্রাণ দিতে হয় জমিদারের স্ত্রীর পরিকল্পনামাফিক। অন্যদিকে জমিদার নিজেকে চৌকস ও কঠোর দাবি করলেও সে চক্রান্তের কোন পরিণতি টানেন না। কারণ ঘেটুপুত্র কমলার মৃত্যু তার মনে কোন ছাপ ফেলে না। বরং আরেক ঘেটুপুত্রের অপেক্ষায় জমিদার তার শেষ সংলাপ টানেন।
ছবিটির প্রেক্ষাপট অতীত, কিন্তু নির্দিষ্ট করে বোঝা যায় না কোন সময়কার বা অঞ্চলের। কয়েকটি দৃশ্যের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলেও ঠিক সেভাবে উপস্থাপিত হয় না প্রেক্ষাপট। তবে রানী ভিক্টোরিয়ার ছবি সংবলিত পয়সার অস্তিত্ব সময়কাল নির্দিষ্ট করে। কিন্তু সংলাপে আঞ্চলিকতার সে প্রসঙ্গ নেই। আবার জমিদার বাড়ির সীমানায় অন্যান্য পরিবেশের উপস্থাপন পুরো এলাকার চিত্রণে সক্ষম হয় না।
চলচ্চিত্র হিসেবে ঘেটুপুত্র কমলার কাহিনী ঐতিহাসিকভাবে কতটা সত্য তাও বোঝা যায় না। আবার বিত্তবানের ভোগ লালসায় ঘেটুপুত্রের প্রকাশ্য ব্যবহারকে তখনকার সমাজ কীভাবে মেনে নিয়েছিল কিংবা আদৌ মেনে নিয়েছিল কিনা সে প্রশ্নেরও উত্তর নেই সিনেমায়। কারণ গল্পে মানবিকতার উপকরণ থাকলেও সে অর্থে কোন অর্থবহতা নেই। একজন মৌলভী চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়েছে কেবল ন্যারেটিভ অর্থে, তার অন্যায় অবিচার বোঝার ক্ষমতা শিশুদের তুলনায় কম। ছবির প্রথমাংশের ঘটনাপ্রবাহ, দ্বিতীয়াংশের গতিতে এসে থেমে যায়। কমলাকে হত্যার চক্রান্ত জানার পর একজন চিত্রকরকে দেখি প্রতিবাদহীন। এমনকি ছবির শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। অর্থাৎ পুরো ছবিতে কমলার নিয়তি যেন জোরারোপ। আগে থেকেই অনুমেয়। তবে এটা যদি নিশ্চিত হয়- জমিদারদের শাসনের আরেক চিত্র অনেকটা সচেতনভাবে প্রতিবাদহীন চরিত্রের মাধ্যমে নির্দেশক তুলে ধরেছেন যা ইতিহাসকে ধারণ করতে সক্ষম, তাহলে সবটাই সঠিক। জমিদারদের কামাচারের বলি ঘেটুপুত্ররাও; সেটা অনেক কিছুরই প্রতীক হতে পারে। বাইজী-নর্তকী-দাসীদের কথা জানা থাকলেও ঘেটুপুত্রদের কথা হয়তো অনেকেই জানি না। হুমায়ূন আহমেদ এক নির্মম সত্য কাহিনীর মাধ্যমে সেই বাস্তবতার গল্পকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ ছবির শক্তিশালী দিক এর নান্দনিক ও বাস্তবসম্মত পরিবেশ। জলাবদ্ধ পরিবেশকে উপস্থাপনের জন্য যেমন জলের প্রয়োজন ছিল, আবার জল শুকিয়ে যাওয়ার পর শুকনো জমির পাশে জমিদার বাড়ি-তার সবটাই ছিল এ ছবিতে। জমিদার চরিত্রে তারিক আনাম খান অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনয় করেছেন। কমলার চরিত্রে মামুনকে হয়তো দেখানো হয়েছে অত্যন্ত নমনীয়, মামুন করেছেও তাই। গানগুলো দেশীয় সংস্কৃতির শতভাগ পরিবাহক। তবে ‘যমুনার জল দেখতে কালো স্নান করিতে লাগে ভাল’ সে সময়কার গান কিনা সেটা বোঝার উপায় নেই। গানের দলের বয়াতী পরিবার অত্যন্ত চমৎকার। এছাড়া ঘেটু দলের অধিকারী কমলার পিতা চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও নৃত্য শিক্ষক প্রাণ রায়ের অভিনয় অনবদ্য। জমিদার স্ত্রী চরিত্রে মুনমুন আহমেদ মানানসই তবে কমলার মায়ের চরিত্রে তমালিকার অভিনয় অনেকটা আরোপিত ছিল। ভাসাভাসা অগভীর চরিত্রের চিত্রকরের ভূমিকায় কণ্ঠশিল্পী আগুন এবং মৌলভীর চরিত্রে আবদুল্লাহ রানা বেশ সাবলীল অভিনয় করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের ছবির কারিগরি দিক যথাযথ আগের মতোই। নতুনত্বের দিক বিবেচনা করলে চিত্রগ্রহণের কাজটি মাহফুজুর রহমান খান অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে করেছেন। আলোআঁধারির দৃশ্যগুলো সচেতনভাবে করছেন ভেবে নিলে সুখকর। ফারুক আহমেদের উপস্থিতি না থাকলেও কণ্ঠ ছিল দর্শকদের কাছে আনন্দের, ফজলুর রহমান বাবুর সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে এ ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছেন। এছাড়া আবহ-সঙ্গীত মানানসই।
চলচ্চিত্র হিসেবে ঘেটুপুত্র কমলা কেমন ছবি? সে উত্তর দর্শকদের কাছে থাকলে দর্শক হিসেবে আমি বলব, বিষয় নির্বাচনের দিক দিয়ে ভাল একটি ভাল ছবি। শিশু নির্যাতন এবং মানুষের বিকৃত মানসিকতার বিরুদ্ধে অসম্ভব আবেদনময় এবং সময় উপযোগী একটি চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলা। সেই সাথে জমিদার প্রথার একটি চলিত প্রথা জানা হয় আধুনিক সমাজের মানুষদের। গুণী এই সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারের প্রস্থানের পূর্বে এ ধরনের বক্তব্যনির্ভর একটি সাহসী ছবি নির্মাণ তাঁকে আরও মহৎ করে তুলেছে নিঃসন্দেহে। তাঁর সেই সাহসী একটি পদক্ষেপের কারণে বলতেই হয় ‘জয়তু হুমায়ূন আহমেদ’।

No comments

Powered by Blogger.