নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা by নিয়ামত হোসেন

শনিবার ছিল আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এ উপলক্ষে সেদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে প্রকাশিত নানা তথ্যে বাংলাদেশে সাক্ষরতা সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এক তথ্যে জানা গেছে, এখন দেশে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৩ লাখ ।


নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করার উদ্যোগ রয়েছে এবং সে ব্যাপারে চেষ্টাও চলছে। সরকার এগোচ্ছে একটা লক্ষ্য নিয়ে, বলছে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করার কাজ সম্পন্ন করা তাদের লক্ষ্য।
২০১৪ সাল মানে আর দু’বছর। লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করলে কাজে সাফল্য পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। পরিকল্পনা মাফিক এগোলে সাফল্য এক্ষেত্রে আসতেও পারে। পুরোপুরি সাফল্য না এলেও এ কাজে অগ্রগতি যে অনেকখানি হতে পারে, সেটি নিশ্চিত। এ প্রসঙ্গে দেশে সাক্ষরতার হারটির দিকে একটু তাকানো যাক। ১৯৭১ সালে দেশের সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ১৯৯১ সালে এই হার ছিল ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং এখন ২০১২ সালে এই হার হচ্ছে ৫৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। একাত্তর সালের তুলনায় লোকসংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। তবে সাক্ষরতার হারও যে বেড়েছে তা পরিষ্কার। সাক্ষরতার হার বাড়ছে অর্থাৎ নিরক্ষরতার হার কমছে এটা বোঝা যায়। লক্ষণটি ভাল। তবে এখনও যে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিরক্ষর হয়ে রয়েছে তাদের সবাইকে আগামী দু’বছরে সাক্ষর করে তোলার কাজটি যে যথেষ্ট কঠিন তাতে সন্দেহ নেই। কঠিন হলেও সাফল্যের প্রত্যাশা সবারই থাকবে। দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা খুবই জরুরী হয়ে উঠেছে।
এটা একবিংশ শতাব্দী। এটা বিজ্ঞানের যুগ, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের যুগ। এই যুগে কোন মানুষ নিরক্ষর হয়ে থাকবে এটা কোনভাবেই কারও প্রত্যাশিত হতে পারে না। দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। সেই লক্ষ্যে কাজও চলছে। এ অবস্থায় দেশে বেশকিছু লোক আবার জ্ঞানশূন্য হয়ে থাকবে এটা কী করে হয়! সেজন্য নিরক্ষরতা দূর করার কাজটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একাত্তর সালে স্বাধীনতার পর চারটি দশক পার হয়ে গেছে। চার দশক সময় কম নয়। চার দশক পরেও দেশে এখনও নিরক্ষরতা থাকা উচিত ছিল না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেটি এখনও রয়ে গেছে। দেশে সমস্যা এই চার দশকে বেশকিছু ছিল, যার জন্য সামগ্রিকভাবে অনেক কিছু অর্জিত হতে পারেনি। এখনও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। এখানে শ্রীলঙ্কার কথা উল্লেখ করা যায়। শ্রীলঙ্কা শতভাগ সাক্ষরতার দেশ, শিক্ষার হার সেখানে শতভাগ। শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘকাল ছিল অস্থিরতা, ছিল যুদ্ধের পরিবেশ। তারপরও দেশটি পূর্ণ সাক্ষরতার এই বড় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে। নানা প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও তাদের এ সাফল্য উল্লেখ করার মতো।
মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এদেশের মানুষ। নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে আন্দোলন, সংগ্রাম এবং শেষ পর্যন্ত জীবনদানের মাধ্যমে রক্ষা করেছে এদেশের মানুষ। অথচ পরিতাপের বিষয়, এই প্রিয় ভাষার প্রিয় অক্ষরগুলোকে এত বছর পরেও সবার কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়নি। অগণিত মানুষের সঙ্গে বাংলা অ আ ক খ-এর পরিচয় নেই। এদের সঙ্গে বই খাতার কোন সম্পর্ক নেই। এদের জীবন কাটে লেখাপড়ার বাইরে।
এ দেশ অমিত সম্ভাবনার দেশ। এটা বোঝা যায় যেসব তরুণ এখন শিক্ষাগ্রহণ করছে তাদের লেখাপড়ায় সাফল্য দেখে, তাদের পরীক্ষার ফল দেখে। এতে বোঝা যায় এদেশের ছেলেমেয়েরা, এ দেশের মানুষ সুযোগ পেলে মেধার পরিচয় দিতে পারে। সত্যিকার পরিবেশ যদি এরা পায় তাহলে এদের মেধার স্ফুরণ ঘটাতে পারে। যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারে। এ সুযোগ করে দেয়াটাই জরুরী। নিরক্ষরদের জন্য সত্যিকার অক্ষরজ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দিতে পারলে দ্রুত তারা শিক্ষার জগতে চলে অসতে সমর্থ হবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
দেশে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এখন অগণিত ছাত্রছাত্রী ভাল ফল করছে, অর্থাৎ তারা এগিয়ে যাচ্ছে এই বাস্তবতার পাশাপাশি আরেকটি বাস্তবতাও লক্ষ্য করা যায়, সেটা শিক্ষার মানের দিক। অনেকেই শিক্ষিত হচ্ছে। লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু আসলে তারা সবাই সত্যিকার অর্থে কতখানি শিক্ষিত হচ্ছে? অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হওয়া জরুরী। লেখাপড়া শেখা জরুরী। কিন্তু সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত কয়জন হচ্ছে সেটাও ভাবা দরকার।
কেউ অক্ষর চিনলে, নিজের নাম ঠিকানা লিখতে ও পড়তে পারলে সে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। সবাইকে সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। বিশেষ করে নবীন প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সত্যিকার সুশিক্ষার পথে। দেশকে নিরক্ষতা মুক্ত করতে হবে এটা যেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ করণীয়। তেমনি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে, যে শিক্ষা পেলে মানুষ সত্যিকার সুশিক্ষিত হবে, আত্মনির্ভরশীল হতে শিখবে, যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারবে, সেই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। আরও বলা হয়, শিক্ষাই হচ্ছে বল অর্থাৎ শক্তি। সুতরাং শিক্ষার অন্য কোন বিকল্প নেই। এখন যুগ পাল্টে গেছে। এখন লেখাপড়া যত বেশি বিজ্ঞানভিত্তিক হবে ততই সেটি হবে কার্যকর শিক্ষা। মানুষকে অক্ষর চিনতে হবে, লেখাপড়া শিখতে হবে এটা যেমন ঠিক, তেমনি তাদের পড়াশোনাকে করতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা শেখার লক্ষ্যমুখী। নিজেদের ঐতিহ্য-কালচার সঞ্জীবিত করে শিক্ষাকে বিজ্ঞানের লক্ষ্যমুখী করতে পারলে সেটা হবে কার্যকর এবং সময়োপযোগী শিক্ষা। এমন ধারার মধ্য দিয়ে শিক্ষা পেলে ছেলেমেয়রা যুগের উপযোগী হয়ে উঠতে পারবে এবং যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলতে পারবে এবং নিজেরাও এক্ষেত্রে নানা অবদান রাখতে সমর্থ হবে।
শিক্ষার অনেক বিষয়বস্তুও পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে গেছেও অনেককিছু। যেমন এক কালে ধারাপাতে বুড়ি, গ-া, কড়া, ক্রান্তি, ছটাক, সের, মণ ইত্যাদি পড়ানো হতো। ‘কুড়োবা কুড়োবা কুড়োবা লিজ্জে, কাঠায় কুড়োবা কাঠায় লিজ্জে’ পড়ানো হতো এখন সে সবের পাঠ চুকে গেছে। ইদানীং প্রশ্ন উঠেছে এ্যালজেব্রা শেখার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা তাই নিয়ে। আগে কম্পিউটার। ক্যালকুলেটর, মোবাইল ফোন ছিল না। এখন প্রযুক্তি বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের জীবনধারাই পাল্টে যাচ্ছে। দিনে দিনে আরও পাল্টাবে। এখন অগণিত মানুষ কম্পিউটার চালায়, ইন্টারনেট ব্যবহার করে, ফেসবুকসহ নানা আধুনিক ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত। বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন ডিজিটাল দেশ গড়ে তোলার। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই এমন পরিবর্তন প্রয়োজন। ছাত্ররা যাতে যোগ্য কর্মক্ষম সুশিক্ষিত হতে পারে সেই লক্ষ্যে কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। শিক্ষিত হয়ে শুধু চাকরি করার যোগ্যতা অর্জনই নয়, যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, দেশের নানা উৎপাদন কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে সেই উদ্যোগও জোরদার করা দরকার। আজকাল দেখা যায়, অনেক শিক্ষিত মানুষ চাকরি না খুঁজে কেউ কৃষি খামার গড়ে তুলছেন, কেউ মাছ বা হাঁস-মুরগির খামার চালাচ্ছেন বা অন্য কিছু করেছেন। কেউ কেউ কারিগরি কাজ শিখে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন। এই ধারাগুলোকে জোরদার করার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা এগিয়ে চলেছে। সত্যিকার ডিজিটাল এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়তে গেল, তাকে জোরদার ও স্থায়ী করতে গেলে প্রয়োজন শিক্ষিত মানুষের শিক্ষিত জাতির। ডিজিটাল এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সচল, জোরদার এবং তাকে অধিকতর জোরদার করতে পারে শিক্ষিত মানুষ, তথা শিক্ষিত জাতি। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বিষয়ে সর্বাধিক মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.