সমাজ-রাষ্ট্র, পুলিশ ও 'দুধভাত আদিবাসী' by পাভেল পার্থ

নিদারুণভাবে আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রের মনোজগৎ ও নিপীড়নের বারুদ বারবার ঝলসে দেয় আদিবাসী ভুবন। এক আদিবাসী আত্মপরিচয়কে ঘিরেই রাষ্ট্র যা শুরু করেছে, বুঝে হোক না বুঝে হোক রাষ্ট্র তার ঝুরঝুরে রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতাই প্রকাশ করে দিচ্ছে বারবার


ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে তখন উন্মাতাল নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর হাজং জনপদ। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল কুমুদিনী হাজংয়ের ওপর হামলে পড়ে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে শহীদ হন রাশিমণি হাজং। হবিগঞ্জের আমরাইলছড়া চা বাগানের ফাঁড়ি বাগান হুগলীছড়ায় ১৯৪৩-এর দিকে বাগান মালিক এক চা শ্রমিক নারীকে যৌন নির্যাতন করলে চা শ্রমিকরা হাতবন্ধ আন্দোলন শুরু করে। চা বাগান মালিকদের নিরাপত্তা দিতে নির্যাতিত শ্রমিকদের মেরেকেটে ফানা ফানা করে পুলিশ। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে ইকোপার্কবিরোধী আন্দোলনের এক মিছিলে বন বিভাগের সঙ্গে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে পীরেন স্নালকে। এভাবেই খুন হন আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিল, অপহৃত হন কল্পনা চাকমা। র‌্যাব যেমন অন্যায়ভাবে পা কেড়ে নিয়ে তছনছ করে ফেলছে ঝালকাঠির লিমনের জীবন, দিনাজপুরের ইয়াসমীন কি চট্টগ্রামের সীমা চৌধুরী_ সবাই ধর্ষিত ও খুন হন। এভাবেই রাষ্ট্র গঠনের প্রতিটি পর্ব ও কালে সমূলে উচ্ছেদ করা হয়েছে নিম্নবর্গের আসমান-পাতাল। জননিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ নিরাপত্তার সীমানাকে চুরমার করে সকল সময়ই হামলে পড়ে দেশের বেসামরিক জীবনে। যেন এ অন্যায় নয়, যেন পুলিশি হামলার ভেতর এই বেঁচে থাকা 'নিরাপত্তার' এক রাষ্ট্রীয় ঝকমারি। যদিও পুলিশি ব্যবস্থার ভেতর দিয়েই রাষ্ট্র তার টিকে থাকার মাজার জোর তৈরি করে; কিন্তু এ জোরকে বারবার জবরদস্তি হিসেবেই পাঠ করতে বাধ্য হয় দেশের নিম্নবর্গ।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী আবারও অন্যায়ভাবে আঘাত করেছে নিরপরাধ আদিবাসী ভূগোল। ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে জয়পুরহাট ও খাগড়াছড়িতে অন্যায়ভাবে আদিবাসী জনগণের ওপর হামলে পড়েছে পুলিশ। বাণিজ্যিক সিনেমার ভাড়াটে গুণ্ডার মতো জয়পুরহাটে পুলিশ বেধড়ক হামলা চালিয়ে, পিটিয়ে জখম করেছে আদিবাসী দিবসের অধিকার মিছিল। মিছিল থেকে আদিবাসী যুব পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি হরেন্দ্র সিংকে আটক করে রাইফেলের বাঁট দিয়ে নৃশংসভাবে আহত করে পুলিশ। খাগড়াছড়ির পানছড়ি ও মহালছড়িতে আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা গাড়িগুলোকে আটকে দিয়ে রাস্তা পর্যন্ত বন্ধ করে পুলিশ। আদিবাসী দিবসে আদিবাসীদের ওপর নির্মম পুলিশি নির্যাতনের কোনো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেনি রাষ্ট্র। বরং পুলিশ ধর্ষণ করল ত্রিপুরা আদিবাসী এক শিশুকে। তাও জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের মাত্র দু'দিন আগে।
খাগড়াছড়ির পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের আটালটিলা পুলিশ ক্যাম্পের একজন বাঙালি পুরুষ কনস্টেবল ধর্ষণ করেছে ১১ বছরের এক ত্রিপুরা শিশুকে। পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত মেরুং ইউনিয়নের আটালটিলা-নয়মাইল গ্রামের আদিবাসী ত্রিপুরা মেয়েটি গরু চরাতে পাহাড়ে গিয়েছিল। সেখানেই জননিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ তাকে ধর্ষণ করে। কিন্তু কী হবে শেষমেশ? পুলিশি হামলা আর ধর্ষণের ন্যায়বিচার করার মাজার জোর কি রাষ্ট্রের আছে? দিনাজপুরের ইয়াসমীন কি চট্টগ্রামের সীমা চৌধুরীদের ঘটনাটি জনে জনে 'রাষ্ট্র' হওয়ায় রাষ্ট্র এর বিচার করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কি রাষ্ট্র মুখ ফিরিয়ে নেবে? পদ্মা সেতু, বিরোধী দলের নতুন কর্মসূচি কি গ্রামীণ ব্যাংকের মতো ডাকসাইটে ঘটনাগুলোর কাছে আদিবাসী জগতের আহাজারিগুলো কি বারবার 'দুধভাত' হয়ে থাকবে? কারণ ঘটনার পর ধর্ষিতের পরিবার দীঘিনালা পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করে মামলা করতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তারা এক হাজার টাকা দিয়ে ঘটনাটি ফয়সালা করতে বলে এবং মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে নয়মাইল গ্রামের হেডম্যান-কার্বারী ও ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের প্রতিবাদে 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০'-এর ৯নং ধারায় একটি মামলা হয়েছে।
কিন্তু নিদারুণভাবে আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রের মনোজগৎ ও নিপীড়নের বারুদ বারবার ঝলসে দেয় আদিবাসী ভুবন। এক আদিবাসী আত্মপরিচয়কে ঘিরেই রাষ্ট্র যা শুরু করেছে, বুঝে হোক না বুঝে হোক রাষ্ট্র তার ঝুরঝুরে রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতাই প্রকাশ করে দিচ্ছে বারবার। অমুক-তমুক বাহিনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রকে কেন বারবার নিরাপত্তার ব্যর্থ ছল তৈরি করতে হয় বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী কেন নিরপরাধ বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালায়? এসব বাহাস আর দেনদরবার নিয়েই হয়তো রাষ্ট্র বিকশিত হয় 'সুশীল' ভাবাদর্শের জখম ছড়িয়ে। আমরা সেদিকে আজকের আলাপে যাচ্ছি না। কিন্তু রাষ্ট্র যখন আদিবাসী জনগণের ওপর অবিরাম নিপীড়নকে 'নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব-কর্তব্য' হিসেবেই বৈধ করতে চায়; আমাদের দ্বন্দ্বটা সেখানেই। আমরা এটি দেখে অভ্যস্ত হয়েছি যে, জলবিদ্যুতের নামে, সামাজিক বনায়নের নামে, বাণিজ্যিক খননের নামে, কি পর্যটনের নামে, কি নিরাপত্তা স্থাপনা সম্প্রসারণের নামে আদিবাসী জনপদ উচ্ছেদ হবে। জনশুমারিতে আদিবাসী পরিসংখ্যান উধাও হয়েই থাকবে। রাষ্ট্র জনগণের যাপিতজীবন নিয়ে নিরাপত্তার যে পাতানো খেলা খেলে চলে আদিবাসীদের সেখানে 'দুধভাত' বানিয়েই রাখা হয়েছে। আদিবাসীদের নিয়ে রাষ্ট্রের অধিপতি মনস্তত্ত্বের মূলে রয়েছে এক ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিকতা।
আদিবাসী দিবসে পুলিশি হামলা ও পুলিশ কর্তৃক ত্রিপুরা শিশু ধর্ষণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ধারা নিয়ে প্রবল প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হবে আদিবাসী জনগণ। দেশের নিরাপত্তা ও জনসুরক্ষার বলয় নিয়েও দুর্ভাবনার কাল কাটবে না। আদিবাসীরা কোনোভাবেই 'দুধভাত' নন। এ দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতা নির্মাণ থেকে শুরু করে কৃষি ও প্রাণসম্পদের সুরক্ষার বলয় তৈরির আদি কারিগর আমাদের নিপীড়িত আদিবাসী জনগণ। অথচ আমরা বারবার এ ঐতিহাসিক সত্যটি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি।

পাভেল পার্থ :গবেষক ও লেখক
animistbangla@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.