আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন

(পূর্ব প্রকাশের পর) এজন্য একটি কমিটি করা হয় যার প্রধান ছিলেন ড. কামাল হোসেন; অন্য সদস্যরা ছিলেন বিচারপতি এফ কে এম এ মুনএম [পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি], ফকির শাহাবুদ্দীন আহমদ [এ্যাটর্নি জেনারেল], ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাসিমউদ্দিন আহমদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন


উপদেষ্টা ব্যারিস্টার হারুনুর রশীদ, এ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম [পরবর্তীকালে এ্যাটর্নি জেনারেল] ও জেনেভা মিশন প্রধান ওয়ালিউর রহমান [পরবর্তীকালে সরকারের সচিব]। কলকাতা থেকে দু’জন প্রখ্যাত ব্যারিস্টারও এসেছিলেন সহায়তার জন্য। তাঁরা হলেন সুব্রত রায় চৌধুরী ও দীপংকর ঘোষ। নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন দু’জন প্রখ্যাত আইনজ্ঞের সাহায্যও কমিটি নিয়েছিল। তাঁরা হলেন অধ্যাপক জেমচেক ও অধ্যাপক অটো ভন ট্রিফটারার।
[দেখুন, ওয়ালিউর রহমান, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, পূর্বোক্ত]
এভাবে ১৯৭৩ সালের ১৯নং আইনটি প্রণীত হয়। উক্ত আইনটি ‘গণহত্যাজনিত অপরাধ’, “মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বা ‘যুদ্ধাপরাধ’ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধাপরাধীকে আটক, ফৌজদারি আইনে সোপর্দ, কিংবা দ-দান করার অভিপ্রায়ে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত হয়, যা স্থানীয়ভাবে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩] [International crimes (Tribunal) Act 1973] নামে অভিহিত।” এই আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদ অর্থাৎ মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না।
[দেখুন, বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, ’৭৩-এর আইন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার : পূর্বোক্ত]
১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই এই আইনটি পাস হয় এবং সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত হয়। এ কারণে, পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়া আইনটি বাতিল করতে পারেননি বা হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন। কারণ, এর আগে বন্দুকের সাহায্যে তিনি সব তছনছ করে দিয়েছিলেন। এই আইন পাস হলেও নানাবিধ অভ্যন্তরীণ কারণ ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭১ সালের অপরাধীদের আরও ব্যাপক ও সুনির্দিষ্টভাবে বিচার করতে পারেননি। কিন্তু ওই আইনটি অগোচরে সুরক্ষিত হয়।

১৪. আলবদররা ফিরে এলো, শহীদ পরিবাররা বিচার পেলেন না
অনেকদিন আগে একটি মন্তব্য করেছিলাম, এ অধ্যায়ের শুরুতে পুনর্বার সেই মন্তব্যটি করছি মুক্তিযুদ্ধ করাটা হয়ত সহজ ছিল, অন্তিমে মুক্তিযোদ্ধা থাকাটা সহজ ছিল না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এক সময় বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ও ক্ষমতা দখলকারী রাষ্ট্রপতি লে. জে. জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান ও তার অনুসারী সামরিক কর্মকর্তাদের পরবর্তীকালের আচরণ দেখে এই প্রতীতি জন্মেছে যে, তাদের অধিকাংশ বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয়। তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বা মেজর খালেদ মোশাররফ আগে থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। জিয়াউর রহমান ২৫ মার্চ রাতেও সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র উদ্ধারে গিয়ে বাধা পেয়ে বলেছিলেন, ‘আই রিভোল্ট।’
জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা দখলের সঙ্গে আলবদরদের একটি সম্পর্ক আছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর, আমরা দেখেছি আলবদররা পালাচ্ছে। আলবদরদের বৃহৎ অংশ মিশে গেল সাধারণ মানুষের ভিড়ে। যারা পরিচিত তারা চলে গেলেন পাকিস্তানে। আলবদরা ছিল সংঘবদ্ধ। শত্রুদের শায়েস্তা করার বিষয়ে তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোভাব ছিল সংঘবদ্ধ, তাদের ওপর কমান্ড থাকলেও তা ছিল শিথিল; আর শত্রুদের নিয়ে কী করা হবে সে সম্পর্কে তাদের কোন পরিকল্পনা ছিল না। আলবদরদের আশ্রয় দিয়েছেন অনেকে, টাকার বিনিময়ে ছাড়াও পেয়েছে অনেকে। অনেককে গ্রেফতারে শৈথিল্য দেখান হয়েছে। দালাল আইনে কিছু আলবদর ধরা পড়লেও বৃহৎ সংখ্যক ধরা পড়েনি। এরা চুপচাপ বসে ছিল না। এরা সংঘবদ্ধ হচ্ছিল, ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের সংঘবদ্ধ ও সংহত করছিল। পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা আলবদর নেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল। জামায়াতের নেতা গোলাম আযম লন্ডন থেকে তাদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অনেক দেশ তাদের সহায়তা করছিল, ফলে তারাও একটি শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই ধারণার কারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান যে কাজগুলো করেছিলেন তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত। মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদররাও একই কাজ করেছিল। শুধু তাই নয়, যেসব হীন অপরাধের জন্য শাস্তি হিসেবে আলবদরদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল মৃত্যুদ-, তার পরিবর্তে তাদের বরং পুরস্কৃত করা হয়।
জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন প্রথম। বাংলাদেশের সংবিধানের ওপর প্রথম হামলাকারী তিনি। দ্বিতীয় লে. জে. এরশাদ। সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করেছিলেন তারা। আলবদররা যেমন খুনের রাজনীতি করেছে, এরাও তেমন খুনের রাজনীতি করেছেন।
জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিলেন। বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর প্রথম স্টেটসম্যান, যিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরোধিতা করে ধর্মব্যবসায়ীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। রাজাকার-বন্ধু জিয়া দালাল আইনেও যারা দ-ভোগ করছিলেন তাদের সসম্মানে মুক্তি দিলেন। অনেক আলবদর ছাড়া পেল, নেতৃস্থানীয় আলবদররা পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা শুরু করলেন। গোলাম আযম ফিরে এলেন। আলবদররা জামায়াতে ইসলামী নাম ঠিক রেখে শুধু ছাত্রসংঘের নাম বদল করে ছাত্রশিবির করল। জিয়াউর রহমানের এইসব সংশোধনী আলবদর-রাজাকারদের এত খুশি করেছিল যে, ‘বামপন্থী’ নেতা কাজী জাফর আহমদ, যিনি পরে জিয়ার দলে এবং আরও পরে এরশাদের দলে যোগ দিয়ে সিভিল সমাজের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তিনি পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘মওলানা সিদ্দিক [স্বাধীনতাবিরোধী] বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করার যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন তার সুযোগ সরকারই করে দিয়েছেন। সংবিধানের ৩৮ ধারা বাতিলের ফলেই এরা রাজনীতিতে আসতে পেরেছে। ... এরা জাতি ও গণস্বার্থবিরোধী। ... সংবিধানের ৩৮ ধারা বাতিল করে এ সকল জাতীয় দুশমনকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়া একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হয়নি।’ [দৈনিক সংবাদ, ৪.১১.১৯৭৬]
আলবদররা ১৯৭১ সালে খুনের পর খুন করেছিল। জিয়াউর রহমান তাদের অপরাধ শুধু মাফ করা নয়, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন। এতদিন যেসব আলবদর ঘাপটি মেরে বসে ছিল তারা প্রকাশ্যে বেরিয়ে জামায়াতকে সংগঠিত করতে লাগল। ছাত্রশিবির বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে স্বাধীনতার পক্ষের ছাত্রদের রগ কাটতে লাগল। রাষ্ট্রে জামায়াতের রাজনীতি ‘রগকাটা রাজনীতি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে গেল। জিয়া রাজাকার-আলবদরদের সচিব, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ করলেন।
সামরিক শাসন জারি করে লে. জে. জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর করা যেসব আইন বাতিল করে আলবদরদের রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন সেগুলো হলো
১. ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর Ordinance No 63 of 1975-এর মাধ্যমে ‘দালাল আইন বাতিল করা’;
২. ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর Second Proclamation Order No-3 of 1975 প্রথম তফসিল থেকে দালাল আইনের যে সুরক্ষা দেয়া হয়েছিল তা বাতিল;
৩. ১৯৭৬ সালে Second Proclamation Order No-3 of 1976-এর মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুনর্প্রবর্তনের জন্য ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি রহিতকরণ;
৪. ১৯৭৭ সালে Proclamation Order No-1 of 1977 জারি করে সংসদে আলবদরদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ রহিতকরণ;
৫. ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য তাদের আবেদনের অনুরোধ;
৬. ১৯৭৭ সালে Proclamation Order No-1 of 1977 দ্বারা সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ রহিতকরণ!
এক কথায় জেনারেল জিয়াই আলবদর-রাজাকারদের শুধু ক্ষমা নয়, ঘরের ভেতর আশ্রয় দিয়েছিলেন।
একইভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের খুনের ‘দায়মুক্তি’ দেয়া হলো এবং তাদেরকে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া হলো। সুতরাং বলা যেতে পারে, জিয়ার নীতিতে ধারাবাহিকতা আছে। বঙ্গবন্ধু খুনীদের শাস্তি দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। আলবদর বন্ধু জিয়া খুনীদের দ- মওকুফ করে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। এভাবে আলবদরদের, রাজাকারদের ক্ষমা করে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশকে বিভক্ত করলেন জিয়াউর রহমান। আলবদরদের মতো তিনিও বাংলাদেশকে পাকিস্তান করতে চেয়েছিলেন। আলবদররা তার ক্ষমতার উৎস ছিল। আলবদররা তাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল দেখে তিনি আলবদরদের এভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন।
একইভাবে অপারেশন সার্চলাইটে অংশগ্রহণকারী লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া আলবদর-রাজাকারদের ক্ষেত্রে জিয়ার নীতি অনুসরণ করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া আলবদর-রাজাকারদের ক্ষমতায় এনেছেন এবং ১৯৭১ সালের আলবদরদের প্রধান ও উপপ্রধানকে মন্ত্রী করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। এভাবে নতুন শতকের শুরুতে দেখি, আলবদররা আবার ক্ষমতায়।
প্রচলিত আইনে, খুনীকে হেফাজত করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া খুনীদের হেফাজত করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। শহীদদের পরিবারদের ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত করেছেন এই তিনজন ও তাদের সমর্থকরা। মুক্তিযুদ্ধের, শহীদদের, বাংলাদেশের কেউ যদি অবমাননা করে থাকেন তাহলে তারা হলেন জিয়া, এরশাদ ও খালেদা। তারা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। অস্ত্রবাজ এই তিনজন একটি জাতির এবং সে জাতির গৌরবময় ইতিহাসের যে অবমাননা করেছেন তার উদাহরণ ইতিহাসে বিরল।
অনেক আগে লিখেছিলাম, একবার যে রাজাকার সে সব সময় রাজাকার। তেমনিভাবে বলা যায়, একবার যে আলবদর সে সব সময় আলবদর। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, আলবদরদের বিরুদ্ধে গণআদালত করার কারণে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার দেশদ্রোহের মামলা। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদের উত্থান, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য আক্রমণ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বারবার চেষ্টা এবং সবশেষে গুলিস্তানে গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার ইত্যাদি হলো আলবদর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। বেগম জিয়া এভাবে ১৯৭১ সালের মতো অস্ত্রধারী একটি মিলিশিয়া বাহিনী সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যারা ১৯৭১ সালের মতো সেনাবাহিনী ও পুলিশের কমান্ডে থাকবে। কিন্তু জামায়াত ও বিএনপির কমান্ডে কাজ করবে।
১৯৭১ সালে যে আলবদরদের প্রতিরোধ করা হয়েছিল ও তাদের রাজনীতির মৃত্যু ঘটান হয়েছিল; সেনাবাহিনীর সাহায্যে জেনারেল জিয়া ও এরশাদ, সেনাবাহিনীর পরোক্ষ সাহায্যে বেগম খালেদা জিয়া একইভাবে সেই আলবদর রাজনীতি ও আলবদরদের ফিরিয়ে আনলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের চালিকাশক্তি ছিল জনবিরোধী সেনাবাহিনী। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকাও ছিল এক। কিন্তু পাকিস্তান ফেরত আনতে চাইলেই কি পাকিস্তান ফেরত আসবে? আলবদরদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেই কি তা করা যাবে? এ শতকের মূল প্রশ্ন এগুলোই।

১৫. অবশেষে আবারও বিচার
জেনারেল জিয়া-এরশাদ-খালেদার আলবদর-রাজাকার-পুনর্বাসন ও বাংলাদেশের পাকিস্তানীকরণের প্রকল্প যে বাংলাদেশের জনগণ মেনে নিয়েছিল, তা নয়। জেনারেলদের পক্ষে ছিলেন আলবদর-রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধী-পাকিস্তানীমনা আওয়ামী লীগ বিরোধী কল্কে পাওয়া নতুন রাজনীতিবিদ- পচে যাওয়া বামধারার লোকজন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ, মৃদু বাম ও বামধারার মানুষজন। পাকিস্তান আমলে, ১৯৪৮ থেকে পাকিস্তানীরা পাকিস্তানে এক নম্বর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল আওয়ামী লীগকে। বাংলাদেশেও এক নম্বর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা ভুলে গেছেন যে সেনাপ্রতিনিধি, অপারেশন সার্চলাইটে অংশগ্রহণকারী, আলবদর ও পাকিস্তানের মনোভঙ্গির প্রতিনিধি, ধর্মব্যবসায়ী, নারী অবমাননাকারী স্বৈরাচারী লে. জে. এরশাদ বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে বলেছিলেন “We will stay in power for about two years and then handover power to a palitical Party but obviously not to Awami League and Awami League will destroy the Armed Forces.”
লে. জে. জিয়ার আলবদরপ্রীতি ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু সামরিক বাহিনীর সাহায্যে যেহেতু তিনি শাসন করছিলেন সেহেতু কেউ কিছু বলার সাহস করছিলেন না। তবে ক্ষোভ বাড়ছিল। কিন্তু আলবদরদের বিচারের দাবি কেউ করতে পারছিলেন না; কারণ, আলবদররা তখন ক্ষমতায়। এতে অনেকে ছিলেন ভীত, কারণ ১৯৭১ সালের স্মৃতি তখনও অমলিন।
এরশাদ আমলের শেষের দিকে ১৯৮৬ সালে কর্নেল নুরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক আহমদ শরীফ ও আরও অনেকের উদ্যোগে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র। এই কেন্দ্র প্রথম যে উদ্যোগটি নেয়, তা হলো একাত্তরের ঘাতক, বিশেষ করে আলবদর [দেখুন পরিশিষ্ট] ও দালালদের পরিচয় তুলে ধরা এবং ১৯৭১ সালে তারা কী করেছিল তা বাংলার মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া। ঘাতকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা গেল, সুপরিকল্পিতভাবে তারা সেসব প্রমাণ নষ্ট করে ফেলেছে। তাদের কুকীর্তির সবচেয়ে বড় প্রমাণ দৈনিক সংগ্রাম। কিন্তু দেখা গেল বিভিন্ন গ্রন্থাগারে রক্ষিত তারও পাতা কর্তন করা হয়েছে। তবুও বেশকিছু তরুণের সাহায্যে প্রণীত হলো একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়? এই বই সংকলনে শাহরিয়ার কবিরের ভূমিকা ছিল মুখ্য। আমার মনে আছে শাহরিয়ার, আমি, প্রয়াত শিল্পী কাজী হাসান হাবিব ও কাজী মুকুল একটি প্রকাশনা সংস্থা করেছিলাম, নাম ডানা প্রকাশনী। এর পক্ষ থেকে একুশের বই মেলায় বাংলা একাডেমীতে একটি স্টল নিয়েছিলাম। ১৯৮৭ সালে বিকাল থেকে স্টলের সামনে ভিড়। কখন আসবে বই? সন্ধ্যার ঠিক আছে বই এল। নিমিষে শেষ। এই বইটি নতুনভাবে মানুষকে জাগিয়ে তুলল। এরই ধারাবাহিকতায় গঠিত হলো ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’ (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.