নারী পাচার এবং এক কিশোরীর গল্প

ঘর থেকে বেরিয়ে একটু বেড়িয়ে আসার স্বপ্ন৷ এ এমন কী আর চাওয়া! তা পেতে গিয়েই পারভিনের জীবন এখন দুঃস্বপ্ন৷ দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে কখনো আত্মহত্যা কখনো কর্মমুখর, জনবহুল শহর ঢাকায় গিয়ে মাথা গোঁজার কথা ভাবতে হয় তাকে!

যশোরের মেয়ে সুমাইয়া পারভিন৷ সম্মান বাঁচাতে কাল্পনিক নাম ব্যবহার করা হচ্ছে৷ তবে ২০০৭ সালের এক ঘটনার পর থেকে তার বা তার পরিবারের একটু সম্মানও কারো কাছে আছে বলে মনে হয় না৷ বয়স তখন মাত্র ১১৷ মায়ের বয়েসি একজন বললেন তার সঙ্গে যশোরে বেড়াতে যেতে৷ কিশোরী মন আনন্দে লাফিয়ে উঠলো৷ মাকে না বলেই চলে গেল যশোর৷ সেখান থেকে সীমানা পেরিয়ে ভারত৷ তারপর ট্রেনে তোলার আগে একটা ইনজেকশন৷ পারভিনের স্বপ্নমাখা চোখে নেমে এল রাজ্যের ঘুম৷ সেই ঘুম ভাঙে পুনেতে৷ সেখানে তার মতো অভাগিনীদের জন্য বসে আছে অসংখ্য খদ্দের৷ পারভিন বুঝতেই পারেনি নিজের অজান্তে, একটু ভুলের খেসারতে চলে এসেছে অন্ধকার গলির পতিতা পল্লীতে!
বাংলাদেশে পারভিন খুব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনার শিকার নয়৷ সেভ দ্য চিলড্রেন, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাইকেল ম্যাকগ্রাথ জানালেন, গত পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মেয়েকে পাচার করেছে পাচারকারীরা৷ ভালো চাকরি, সুন্দর জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারত বা পাকিস্তানে৷ সেখানে প্রায় সবাইকেই বরণ করতে হয় পারভিনের দুর্ভাগ্য৷ কেউ যে স্বভূমে ফেরার সুযোগ পায়না তা নয়৷ রাইটস যশোর নামের এক বেসরকারি সংস্থার পরিচালক বিনয় মল্লিকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এ বছর প্রথম আট মাসে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৪৮জন নারীকে, ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছেন আরো ১৪৩ জন৷

কিন্তু তারা কি জানেন দেশে কেমন ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য? পারভিনের বাকি গল্পটা শুনলে জানতেন৷ পুনের ওই অন্ধকার পল্লি থেকে তিন দিন পরই পালিয়েছিল পারভিন৷ আশ্রয় নিয়েছিল কাছের পুলিশ স্টেশনটিতে৷ সেখান থেকে এক আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয় তাকে৷ সেখানে আট মাস৷ তারপর কলকাতার আরেক আশ্রয় কেন্দ্রে ১৯ মাস৷ নিরপরাধ এক কিশোরীর জীবন থেকে ২৭টি মাস হাওয়া৷ না বুঝে পরিবারের বন্ধন ছেড়ে অচেনা জগতে অনিশ্চিত জীবনযাপন৷ মেয়েটিকে মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে আশ্রয় কেন্দ্রটি যোগাযোগ করল রাইটস যশোরের সঙ্গে৷ খবর চলে গেল মায়ের কাছে৷ মেয়ের কাছে ছুটে এলেন মা, অনেকদিন পর পারভিন আবার ফিরল নিজের ঘরে৷

তবে ফিরে এসে আর চেনা পরিবেশের চেনা মানুষগুলোকে আগের মতো করে পায়নি৷ আগের জীবনটা নয়, মাঝে কেটে যাওয়া ২৭টি মাসই যেন সবার কাছে বড়! ওই সময়টুকুর কথা তুলে সবাই সবসময় কটাক্ষ করে৷ পারভিন চেয়েছিল লেখাপড়া শিখে প্রতিষ্ঠিত হতে৷ ভর্তি হলো স্কুলে৷ কিন্তু সহপাঠী এবং অন্যদের অশ্লীল মন্তব্যের জ্বালায় টেকা দায়৷ সবার কাছেই যে ঘৃণার পাত্রী হয়ে গেছে এটা বুঝতে পেরে পারভিন এখন নিজের ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি৷ প্রায়ই আত্মহত্যার ইচ্ছের কথা জানায় মাকে৷ মা বুকে জড়িয়ে শোনায় নতুন আশার বাণী৷ তাই স্বপ্ন এখন ঢাকা শহরে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই আর একটা চাকরি৷

তো পাচারকারীদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া মানেই কি প্রকৃত মুক্তি? নাকি তারপর চেনা পরিবেশে প্রায় অজেয় এক লড়াইয়ের সামনে নিজেকে দাঁড় করানো? বিনয় মল্লিক জানালেন, অনেকের মনে আশঙ্কাটাই বড় হয়ে ওঠে বলে তারা আর দেশেই ফিরতে চান না৷ সূত্র: রয়টার্স।

No comments

Powered by Blogger.