কলকাতার চিঠি by ঊর্মি রহমান

গত চিঠিতে খাপ পঞ্চায়েতের কথা লিখেছিলাম। পরে মনে হলো ‘খাপ’ কি, সেটা বুঝিয়ে না বললে ব্যাপারটা খাপছাড়া হয়ে যাবে। খাপ হচ্ছে বর্ণ ও ভৌগোলিক এলাকাভিত্তিক এক গুচ্ছগ্রাম; আর তারই পঞ্চায়েতের নাম খাপ পঞ্চায়েত। এর শুরু চতুর্দশ শতকে। শুরু করেছিল উচ্চবর্ণীয় একদল জাঠ। উদ্দেশ্য, তাদের ক্ষমতা ও অবস্থানকে সমুন্নত রাখা।


সমগোত্রীয় লোকজন মিলে এই পঞ্চায়েত তৈরি হয়। এটা সাধারণত হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশ ও রাজস্থানের কোন কোন এলাকায় দেখা যায়। খাপ পঞ্চায়েত তাদের নিয়মনীতির ব্যাপারে অনড়। খাপ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করাসহ বেশ কিছু বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই নিয়ম ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান আছে। প্রেমজ বিয়ের কারণে বহু যুগলকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। পরিবার ও গ্রামের সম্মান রক্ষার নামে খাপ পঞ্চায়েত তাদের হত্যা করেছে অথবা আত্মহত্যায় বাধ্য করেছে। নির্বাচিত পঞ্চায়েতকে খাপ পঞ্চায়েত উপেক্ষা করে। ফলে তাদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণই এসব এলাকায় চলে। এই খাপ পঞ্চায়েতের সদস্য সংখ্যা ১০-১৫জন। ধরুন, কোন খাপ পঞ্চায়েত প্রেম করে বিয়ে করার জন্য কোন যুগলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো। সেটা যত ভয়াবহই হোক না কেন, তাদের পরিবার সেটা মেনে নেয়। হয়ত তারাই মেয়েকে (বা ছেলেকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েকে) কীটনাশক খাইয়ে বা অন্য কোন উপায়ে মেরে ফেলে। ছেলেমেয়ে যদি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে পরিবারের ওপর শাস্তির দ- নেমে আসে। বিপুল অর্থ জরিমানা দিতে হয়। এই দূর্ভোগ এড়াবার জন্য অনেক পরিবারই ছেলেমেয়ের বাল্যবিয়ে করিয়ে দেয়, যাতে তারা প্রেমে পড়ার সুযোগ না পায়। সরকার খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে সে রকম কিছু করেনি। ফলে এই যুগের সঙ্গে বেমানান ব্যবস্থা চলে আসছে। সরকার করেনি, কিন্তু অভিনেতা আমির খান তাঁর ‘সত্যমেব জয়তে’ অনুষ্ঠানে খাপ পঞ্চায়েতের কিছু সদস্যকে এনেছিলেন, সেখানেও তারা ভিন্ন ধর্ম বা বর্ণে বিয়ে করার বিরুদ্ধে বলেন। কিন্তু তাঁদের বক্তব্যের বিরোধী মতও সেখানে প্রচার করা হয়। টিভি পর্দায় খাপ সদস্যদের মুখের কঠোর অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গিয়েছিল তাদের রক্তে মিশে আছে এমন সংস্কার যা আজকের যুগে অচল হলেও তারা সেটা রক্ষার জন্য যত দূর প্রয়োজন যেতে রাজি। এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে ধর্মান্ধ মুসলমান গোষ্ঠীর খুব একটা পার্থক্য নেই। কাশ্মীর উপত্যকায় একটি এলাকার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়েছে, যাতে বলা হয়েছে মেয়েরা মুখ ঢেকে না চললে তাদের মুখে এ্যাসিড ছুঁড়ে মারা হবে আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাদের গুলি করে মারা হবে। পোস্টারে যাদের নাম আছে তারা হলো লস্কর-আল-কায়দা এবং আল-কায়দা-মুজাহিদীন। এই দু’টি গোষ্ঠীর নাম এর আগে শোনা যায়নি। তাই কর্তৃপক্ষ বুঝে উঠতে পারছে না সত্যিই এ রকম কেউ আছে নাকি এই পোস্টারগুলো নিছক রসিকতা করে লাগানো হয়েছে। শুধু কাশ্মীরে নয়, রাঁচিতেও এ রকম ফতোয়া জারি হয়েছে যে, মেয়েরা জিন্স্ পরলেই তাদের গায়ে এ্যাসিড ছুঁড়ে মারা হবে। এই ফতোয়া দিয়েছে ঝাড়খ- জনমুক্তি সঙ্ঘ। এসব এলাকায় নারীর অকিারের কোন মূল্য নেই। যাক এসব প্রসঙ্গ, শুনলে শুধু মনে হয় আমরা এখনও অন্ধকার যুগে বাস করছি। তার চেয়ে বরং এমন বিষয় নিয়ে কিছু বলি যা আপনার-আমার সবারই খুব প্রিয়।
সেটা হচ্ছে ইলিশ মাছ, যাকে বাদ দিলে বাঙালীর জীবন হয়ে ওঠে স্বাদ-গন্ধহীন। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এখন বর্ষা। দেশে ফেরার সময় ভেবেছিলাম, বাইরে ঝম ঝম বৃষ্টির সঙ্গে আমি খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা খাব। এর কোনটাই হয়নি, কারণ সেভাবে এখনও বর্ষা নামেনি আর ইলিশ মাছের দাম আকাশছোঁয়া। অধিকাংশ বাঙালীর কাছে বোধ হয় ইলিশ মাছের মতো প্রিয় আর কিছু নেই। শুনেছি কলকাতায় ফুটবল খেলায় ইস্টবেঙ্গল দল জিতলে বাজারের সমস্ত ইলিশ বিক্রি হয়ে যায় আর মোহনবাগান জিতলে চিংড়ি মাছ। ঘটি-বাঙাল আর ইলিশ-চিংড়ির এই বিভাজন আমার ঠিক মাথায় ঢোকে না। কারণ ঘটি হোক আর বাঙাল, সব বাঙালীর কাছেই ইলিশ মাছ ভীষণ প্রিয়। আমি ইলিশ মাছ বেশিদিন না খেয়ে থাকতে পারি না, অন্যদিকে চিংড়ি মাছও আমার খুব প্রিয়। শুধু আমার কাছে নয়, অনেক মানুষের কাছেই এই দু’টি মাছই সমান পছন্দের। তাই এবার ইলিশ মাছের আকাল হওয়াতে বাঙালীর খুব সময় খারাপ যাচ্ছে। এক তথ্যে জানা গেছে, ২০১০ সালে এখানে ৫০ হাজার টন ইলিশ ধরা হয়েছিল। গত বছর ধরা পড়েছে ১৬ হাজার টন। এ বছর নিশ্চয় তারও কম। এক মাছ ব্যবসায়ী বলেছেন, ১০০০ টাকা কেজি দাম চাইতে লজ্জাই লাগে, তাই তিনি ইলিশ রাখছেন না।
এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করাতে এখানে বেশ হৈচৈ উঠেছে। আসলে এই নিষেধাজ্ঞা চিংড়ি ছাড়া সব সামুদ্রিক মাছের বেলাতেই, কিন্তু এপারের বাঙালীর হৃদবেদনার কারণ শুধু ইলিশ মাছ। টিভির পর্দায় এক ক্রুদ্ধ মাছ ব্যবসায়ীকে বলতে শুনলাম, বাংলাদেশ তো আমাদের আর কিছুই দেয় না, শুধু ইলিশ মাছ। সেটাও বন্ধ করে দিল? পরে দেখলাম কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা শুধু রমজান মাসের জন্য। ঈদের পর আবার ইলিশ আসবে। কোন কোনদিন বাজারে গিয়ে দেখি প্রচুর ইলিশ উঠেছে। জানা গেছে, গঙ্গাসহ অন্যান্য নদীতে হঠাৎ করেই অনেক ইলিশ ধরা পড়েছে। সেই মাছ ৮০০/৯০০ টাকায় কিনে বাড়ি ফিরি। সেটাও যে সবার নাগালের মধ্যে সেটা বলা যাবে না। মনে পড়ল গত বছর আমরা কলকাতার অদূরে গাঁধিয়ারা বলে এক জায়গায় গিয়ে খুব ভাল ইলিশ আর গলদা চিংড়ি কিনেছিলাম। রূপনারায়ণ নদীর পারের ঐ জায়গাটার কাছেই এক কলেজে আমাদের এক জামাই রাজর্ষি পড়ায়। ও বলে রাখায় সেই মাছ পেয়েছিলাম। এই ধরনের এ্যাডভেঞ্চার তো আর রোজ রোজ করা যায় না। ইলিশের আকালের কারণে অনেকেরই মন খারাপ। কাগজে এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। টেলিভিশনের নিউজ চ্যানেলগুলোতেও প্রায় এই মর্মে দীর্ঘ আইটেম থাকে। আনন্দবাজার লিখেছে, ইলিশ কি তবে ডোডো পাখি হয়ে যাচ্ছে? টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, ইলিশ ভুলে যাও, এবার ম্যাকারেল ঝোল খাও। তাই কি সম্ভব? যদিও এখানে নাকি এখন প্রচুর সার্ডিন আর ম্যাকারেল ধরা পড়ছে। কিন্তু বাঙালীকে এসব মাছে আসক্ত করাটা সহজ কাজ নয়। বিলেতেও দেখেছি স্যামন মাছ যতই অভিজাত ও দামী বলে পরিচিত হোক, বাঙালীর রসনায় সেটা ইলিশের পাশে একেবারেই নগণ্য বলে বিবেচিত। হিমায়িত ইলিশ কিনেই সেখানকার বাঙালী সর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ কিংবা পাতুরি রান্না করে খাচ্ছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া ’হাই অন হিলশা’ নামে রোজই প্রতিবেদন ছাপছে, যাতে আমরা জানতে পারছি সেলিব্রিটিদের কে কত এবং কেমন করে রান্না ইলিশ ভালবাসেন। পত্রিকাটি সেরা রেস্টুরেন্টের নাম করার জন্য পাঠকদের আহ্বান জানিয়েছে যেখানে তাঁদের প্রিয় ইলিশের পদ পাওয়া যায়।
ইলিশ নিয়ে এত অভাব-অভিযোগ আর সঙ্কটের মাঝেও কিন্তু রেস্টুরেন্টগুলো এবং বিভিন্ন এলাকার কোন কোন রাজনৈতিক নেতা ইলিশ উৎসবের আয়োজন করছেন। ওহ্! ক্যালকাটা তো আছেই। মার্কোপোলো নামের একটি রেস্টুরেন্টের বাইরে দেখি বিরাট বিরাট করে লেখা ’বোনলেস’ বা হাড়বিহীন ইলিশ উৎসব চলছে। একদিন গেলাম। খুব আশা ছিল স্মোকড্ ইলিশ পাওয়া যাবে, দেখলাম সেটা নেই। তবে অন্য অনেক কিছু আছে, ভাপা ইলিশ থেকে ইলিশ বিরিয়ানি (মানে ইলিশ পোলাও) আছে। এই ইলিশ খেতে শুধু বাঙালী নয়, কিছু অবাঙালী খাদ্যরসিককেও দেখা গেল। আমরা মরিচ-ঝাল ইলিশ নামে একটা পদ খেলাম। সেটার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। ইলিশ ছাড়া কি বাঙালীর চলে। শুনলাম, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ একসঙ্গে মিলে ইলিশ মাছ নিয়ে কিছু একটা করবে। যেমন জাটকা বা এপার বাংলার ভাষায় খোকা ইলিশ ধরা বন্ধ বা এ জাতীয় কিছু পদক্ষেপ, যাতে ভবিষ্যতে বাঙালীকে সর্ষে-ইলিশের ঝাঁঝে অশ্রুপাত করতে হয়, ইলিশের অভাবে নয়।

No comments

Powered by Blogger.