নির্বাচন-'বাছবিচার করে পরিবর্তন হয় না' by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

মমতার দলে এসেছেন একগাদা পুলিশ অফিসার_ তাদের কার্যকালের সময় তেমন কোনো 'রেপুটেশন' ছিল বলে জানা নেই। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতি বসুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মুখ্য সচিব মনীশ গুপ্ত তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবকে


হারিয়ে দিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির একটা বিষয়ে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যরা যেসব খবর রাখে তারা তা রাখেন না। পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় তিন বছর ধরে ওসামা বিন লাদেন সপরিবারে বাস করে আসছে, পাক প্রধানমন্ত্রী তা জানতেন না। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম দলে যে ভেতরে ভেতরে ধস নেমেছে এবং ধসটা এত গভীর যে বিধানসভার সিপিএমসহ বামফ্রন্টের আসন ২০১১ সালের নির্বাচনে ২৩৪ থেকে ৬২-তে নেমে আসতে পারে তা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জানতেন না। জানতেন না বলেই তিনি তার সাবেক আমলার কাছে ১৬ হাজার ভোটে হেরে বসে আছেন।
বুদ্ধদেব সদম্ভে বলেছিলেন, 'আবার আমরা বিপুল ভোটে ক্ষমতায় ফিরে আসছি।' এ বিবৃতির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা পকস্ফকেশ বাংলা সাহিত্যের এমএ কবি ও নাট্যকার মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করেন, 'আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা জানতাম না।' কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জানত। মমতা তো জানতেনই। কাঠফাটা রোদ্দুরে গোটা রাজ্য চষে বেড়িয়েছেন তিনি। তিনি যেখানেই গেছেন সেখানে কাতারে কাতারে মানুষ জমায়েত হয়েছে।
গত কয়েক বছরের চেষ্টায় মমতা একটা ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছেন। সাতবার এমপি হয়েও মমতার লাইফস্টাইল বদলায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নিয়েও তিনি আগের মতোই। ভারতের রেলমন্ত্রী হয়েও মা-ভাইবোনদের নিয়ে কলকাতার এক নিম্নমধ্যবিত্ত এলাকায় টালির ছাউনি দেওয়া বস্তির মতো একটা বাড়িতে থেকেছেন। দিলি্লতেও তিনি এমপি ও মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ বাগানঘেরা বাংলো পেয়েও নেননি। অতি সাধারণ বেসরকারি ভাড়া করা ফ্ল্যাট ছিল তার।
মমতার জীবনের সাফল্য, তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। ছাত্রী অবস্থা থেকে তিনি রাজনীতি করেছেন। তিনি টিউশনি করে পড়ার খরচ চালিয়েছেন। ভাইবোনদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। রাজনীতিতে স্তাবকতা নয়, প্রতিবাদ করে বড় হয়ে উঠেছেন। কংগ্রেসের যেসব নেতার সঙ্গে ঝগড়া করে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গড়েন তারা আজ তার দলে, তারই অনুগত। একদা সিপিএমের যে ক্যাডার কলকাতায় তার মাথায় রড দিয়ে আঘাতে তাকে অজ্ঞান করে ফেলেছিল সে আজ তার কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। বারবার এমপি হলেও জনতার একটা বড় অংশ এতদিন মমতা সম্পর্কে নানা কটূক্তি করত। কেউ বলত মমতা পাগলি। নাটক করে। কেউ বলত ভুয়া ডক্টরেট। কিন্তু আজ জনসমর্থনের কারণে এসব কটূক্তি কোথায় ভেসে গেছে।
মমতার এ জয় কভার করার জন্য পৃথিবীর বড় বড় টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র তার হরিশ চ্যাটার্জি রোডের বস্তিবাড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মমতা এখন শুধু একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বস্তি থেকে মহাকরণ_ এ অবিশ্বাস্য উত্তরণ নিয়ে তথ্যচিত্র করছেন একদা সিপিএম সমর্থক এক বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক।
১৯৯৮ সালে তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা। ২০০১ সালে মমতা এনডিএর সঙ্গে জোট করে লড়েন। কিন্তু বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কখনও সমর্থন করেনি। বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা তো নয়ই। তবুও ২০১১ সালের আগে বামরা নানাভাবে ভোট নিয়ন্ত্রণ করত। কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও বুথ দখল করে। তাছাড়া নিজস্ব বিরাট একটি ভোটব্যাংক তো আছেই।
সেবারে মমতা বামদের আসন কমিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারেকাছে যেতে পারেননি। ২০০৬ সালের নির্বাচনে মমতা কোনো জোট না করে একা লড়েছেন। ত্রিমুখী লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঐক্যবদ্ধ বামদের বিরুদ্ধে কখনও জেতা সম্ভব নয়। মমতা মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিলেন। তারপর ২০০৭ থেকে শুরু হলো সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো কারখানার জন্য জোর করে জমি অধিগ্রহণ। ২০০৮ সালে নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাবের জন্য গ্রাম উজাড় করার নোটিশ। বামফ্রন্টের কবর বাম ফ্রন্টই খুঁড়েছিল।
২০০৬ সালে ক্ষমতায় এসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দেশি-বিদেশি শিল্পপতিদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের চুক্তি করেন। সে জন্য ব্রিটিশ আমলের এক আইন মোতাবেক সরকার নামমাত্র দামে জোর করে কৃষিজমি অধিগ্রহণ শুরু করে। সে সময় বুদ্ধদেবকে মিডিয়া চিহ্নিত করছে 'ব্র্যান্ড বুদ্ধ' বলে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও নাকি বুদ্ধদেবের এ শিল্পায়ন কর্মসূচি দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন। একটি কাগজ শিরোনাম দেয়, 'মনমোহনের মন কেড়েছিল শিল্পায়নের বুদ্ধ।' কিন্তু মমতা গিয়ে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে চাষিদের পাশে দাঁড়ান। শুরু হয়ে যায় সরকারি নির্যাতন, গুলি, লাঠি। ক্যাডাররা পুলিশের পোশাক পরে বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে নেমে পড়ে। একের পর এক মহিলা ধর্ষিত হয়, খুন হয়। মমতা তার লাইন পেয়ে যান। শিল্পায়ন স্তব্ধ হয়ে যায়। সিঙ্গুরে টাটা কারখানা অর্ধেক হয়ে পড়ে থাকে। টাটারা গুজরাট চলে যায়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে চলে সিপিএম ও তৃণমূল ক্যাডারদের মধ্যে সংঘাত। বীরভূম, বর্ধমান, উত্তর চবি্বশ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকটি ব্লকে গৃহযুদ্ধের মতো পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ শেষ আঘাত আসে পশ্চিম মেদিনীপুরের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা জঙ্গলমহল থেকে। সেখানে মাওবাদী ও সিপিএমের মধ্যে সংঘর্ষে ২০১০-১১ সালে ৫০০ মানুষ খুন হয়। এর মধ্যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে নেতাই গ্রামে। সেখানে সিপিএম সশস্ত্র শিবির থেকে ক্যাডাররা নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর গুলি চালিয়ে ৯ জনকে মেরে ফেলে।
এর ওপর বেকারি (এক কোটি বেকার), আর্থিক দুরবস্থা (রাজ্য সরকারের দেনা দুই লাখ কোটি টাকা)_ সব মিলিয়ে রাজ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য রাজ্যবাসী চেয়েছিল পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ধাক্কায় বামফ্রন্ট এবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটে ধুয়ে-মুছে সাফ করে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীসহ ২৭ মন্ত্রী হেরেছেন। অনেক মন্ত্রী এবার নমিনেশন পাননি। তারা বেঁচে গেছেন। মন্ত্রীদের কেউ কস্মিনকালে ভাবেননি যে, তারা কখনও হারতে পারেন।
প্রতিটি প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষায় বাম বিপর্যয়ের যে আগাম আভাস দেওয়া হয়েছিল তা উড়িয়ে দিয়ে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এটি 'মিডিয়া সন্ত্রাস'। আরেকটি বিখ্যাত সংবাদপত্র ভোট শেষ হওয়ার আগে মমতার ক্যাবিনেটে কে কে থাকছেন তা ছাপিয়ে দেয়। বিমান বসু এটিকে বলেন, 'পেড নিউজ' অর্থাৎ টাকা দিয়ে এ খবর ছাপানো হয়েছে।
কেউ বলছে, জনসাধারণের অবস্থা যে বামদের ওপর থেকে ধসে গেছে এটি তারা বুঝেও বোঝেননি। ভেবেছেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কমিউনিস্টদের হটানো অত সহজ নয়। তাছাড়া পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সরকারকে একটি মনপছন্দ গোপন রিপোর্ট দিয়ে বলেছিল, বামরাই আবার প্রত্যাবর্তন করবে।
আরেক দল বলছে, বামরা বুঝতে পেরেছিল, পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে। পার্টি ক্যাডারদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। পার্টি ক্যাডারদের ধরে রাখার জন্য সর্বত্র নির্দেশ দিয়েছিল, 'আমরা প্রত্যাবর্তন করছি_ এটি চাউর করে দিতে হবে।' তাই পার্টির সবাই একবাক্যে বলেছিলেন, 'এবারও আমরা বিপুল ভোটে ক্ষমতায় ফিরে আসছি।' এ ফিরে আসার তারা নামকরণ করেন 'প্রত্যাবর্তন'। শেষ পর্যন্ত এটিই ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়_ পরিবর্তন, না প্রত্যাবর্তন।
মহাকরণে একজন ধর্ষিত মূক-বধির বালিকাকে নিয়ে একদা মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে সুবিচারের আশায় গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন তিনি এমপি। মমতাকে জ্যোতি বসু দু'চোখে দেখতে পারতেন না। তিনি সে সময় তার চেম্বারে ছিলেন। পুলিশ এসে বলল, আপনার সঙ্গে মমতা দেখা করতে চান। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, 'আমি দেখা করব না।' মমতা সেই কথা শুনে মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারের সামনে বসে পড়েন। পুলিশকে জ্যোতি বসু বলেন, 'ওকে মেরে তুলে দাও।' তখন লালবাজার থেকে মহিলা পুলিশ এনে মমতার চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে তাকে ও তার সঙ্গীদের রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়। এটি ১৯৯৩ সালের ৭ জানুয়ারির ঘটনা।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে ছিল প্রেস কর্নার। প্রেসের লোকরা সব ঘটনা স্বচক্ষে দেখে রিপোর্ট করে। এটি দেখে জ্যোতি বসু তার তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বলেন প্রেস কর্নার ভেঙে দিতে। প্রেসকে এমন জায়গায় পাঠাতে যাতে তারা এমন কিছু ঘটনা দেখতে না পায়। প্রেস কর্নার ভেঙে ফেলা হয়। তাই নিয়ে সাংবাদিকরা দীর্ঘ আন্দোলন করেও সরকারকে নড়াতে পারেননি। প্রেস ক্লাব সভাপতি হিসেবে পরবর্তীকালে আমি তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বহু অনুরোধ করেও তাকে টলাতে পারিনি।
বুদ্ধদেব ও মমতা কখনও এক মঞ্চে বক্তব্য রাখতে আসেননি। মমতার নাম মুখে আনতেন না বুদ্ধদেব। বলতেন, 'ওই উনি।' হিন্দুদের মধ্যে নিয়ম আছে, ছোট ভাইয়ের বৌ ভাশুরের নাম ধরে না। কিন্তু ভাশুর ভাদ্র বৌয়ের নাম ধরবে না কেন? তবে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতি হিংসা-ঘৃণা ও ত্রাসের রাজনীতি। আমরা আর ওরার রাজনীতি। এবার 'ওরা' আমরায় পরিণত হয়েছে। মমতার দলে এবার একগাদা বুদ্ধিজীবী এসে গেছেন। তারা প্রায় সবাই এতদিন 'ব্র্যান্ড বুদ্ধ'-এর সমর্থক ছিলেন। কেউ সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় হাওয়া বুঝতে পেরে সিপিএমের ফুটো নৌকা থেকে সরে পড়েছেন। মমতার দলে এসেছেন একগাদা পুলিশ অফিসার_ তাদের কার্যকালের সময় তেমন কোনো 'রেপুটেশন' ছিল বলে জানা নেই। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতি বসুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মুখ্য সচিব মনীশ গুপ্ত তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবকে ১৬ হাজার ভোটে হারিয়ে দিলেন। মমতার প্রার্থী নাট্যকার ব্রাত্য বসু, জীবনে যিনি রাজনীতি করেননি, প্রথম ভোটে দাঁড়িয়ে সিপিএমের এখনকার সবচেয়ে ঘাগু নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার গৌতম দেবকে প্রায় ৩১ হাজার ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন। নায়িকা দেবশ্রী রায় সুন্দরবন অঞ্চলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রীকে হারিয়ে দিয়েছেন। নিপাট ভদ্রলোক জনপ্রিয় গায়ক অনুপ ঘোষাল পর্যন্ত সিপিএমের এক জাঁদরেল মহিলা নেত্রীকে হারিয়ে দিলেন। ভোটাররা অনেকেই আমাকে বলেছেন, 'আমরা কে কার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে তা দেখিনি_ আমরা পরিবর্তন চেয়েছি।' বাছবিচার করে পরিবর্তন হয় না। এই মমতাকে কয়েক বছর আগেও লোকে বলত পাগলি। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। কেউ বলত নাটুকে। সিপিএম অপপ্রচারে ইন্ধন জোগাত। বলত, ওর টালির বাড়িতে থাকা, চটি জুতা আর ছেঁড়া শাড়ি_ সবই ভান। কিন্তু দেয়ালের লিখন তারা কেউ পড়তে পারেননি।


ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.