কৃষকের ৪৫টি নলকূপ ক্ষমতাসীনদের কবজায়! by আনোয়ার পারভেজ

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) থেকে কৃষকের নামে বরাদ্দ আসা নয় কোটি ৬৬ লাখ টাকার ৪৫টি গভীর নলকূপের বেশির ভাগই এখন বগুড়ার ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের কব্জায়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেচখরচ বাবদ টাকা না নিয়ে কৃষকের ধান নিজেদের গোলায় তুলছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।


বিএডিসি সূত্র জানায়, কৃষকের সেচসুবিধা নিশ্চিত করতে বছর দুই আগে ‘বগুড়া ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় গত অর্থবছর গভীর নলকূপগুলো স্থাপন করা হয়। এসব নলকূপ কৃষকদের অংশীদারির ভিত্তিতে স্থাপনের কথা থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের এক সাংসদের সুপারিশে তা দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ভাগ-বাটোয়ারা: বিএডিসি সূত্র আরও জানায়, জেলার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, গাবতলী, ধুনট, শেরপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় নলকূপগুলো স্থাপন করা হয়। ৪৫টি গভীর নলকূপের মধ্যে বগুড়া-১ আসনের সাংসদ আবদুল মান্নানের সুপারিশে ৩৩টিই বরাদ্দ দেওয়া হয় তাঁর নির্বাচনী এলাকা সোনাতলা ও সারিয়াকান্দিতে। এর মধ্যে সোনাতলায় ১৬টি, সারিয়াকান্দিতে ১৭, গাবতলীতে তিন, ধুনটে চার, শিবগঞ্জে তিন ও শেরপুরে দুটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়।
বিধি অনুযায়ী, বিএডিসির গভীর নলকূপ পরিচালনার জন্য সেচ স্কিম এলাকার কৃষকদের নিয়ে একটি দল গঠন করতে হয়। এরপর কৃষক দলকে অংশীদারি ফি হিসেবে নলকূপ স্থাপন, বিদ্যুৎসংযোগ ও ভূগর্ভস্থ সেচনালা তৈরি বাবদ নলকূপপ্রতি ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা বিএডিসিতে জমা দিতে হয়। সেচ এলাকার দলভিত্তিক কৃষকের মনোনীত ব্যক্তিকেই ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা। ব্যবস্থাপক নিয়োগে সাধারণ কৃষকের মতামতও নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিএডিসির এক কর্মকর্তা জানান, সাংসদ আবদুল মান্নানের সুপারিশ করা তালিকা অনুযায়ী নলকূপের বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
যাঁরা নলকূপ পেলেন: এক মাস ধরে এই প্রতিবেদক সোনাতলা ও সারিয়াকান্দিতে খোঁজখবর করেন। বিএডিসির নথিতে ব্যবস্থাপকের তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নামই খুঁজে পাওয়া গেছে। সারিয়াকান্দিতে ১৭টির মধ্যে তিন-চারটি বাদে সবকটিই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বরাদ্দ পেয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ফুলবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ারুত তারিক, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম, ভেল্লাবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক আইনুর রহমান, নারচি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আহসান উল্লাহ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান আলীর ভাই শাহীন-উল-আলমসহ বেশকিছু নেতা-কর্মী রয়েছেন।
সোনাতলা উপজেলাতেও ১৬টির মধ্যে চার-পাঁচটি বাদে বাকিগুলো ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কব্জায় রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুল আনোয়ারের ছেলে ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নবীন আনোয়ার, দিকদাইর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নূরে আলম ওরফে বাবলু, জোড়গাছা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিন, একই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনারুল ইসলাম, সোনাতলা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলে একরামুল হকসহ বেশকিছু নেতা-কর্মী রয়েছেন।
একাধিক কৃষক অভিযোগ করেন, স্কিম এলাকায় এক শতাংশ জমিও নেই—এমন অনেক নেতা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নলকূপ বরাদ্দ পেয়েছেন।
সোনাতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুল আনোয়ার বলেন, ‘নিয়ম মেনে সবাই গভীর নলকূপ বরাদ্দ নিয়েছেন। আমার ছেলে রাজনীতি করলেও চাষাবাদ করে। এ জন্য সে নলকূপ বরাদ্দ পেয়েছে।’
কৃষকের ধান নেতাদের গোলায়: গত বোরো মৌসুমের শেষ মুহূর্তে সরেজমিনে সোনাতলা ও সারিয়াকান্দির বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সেচখরচের নামে কৌশলে কৃষকের কষ্টে ফলানো ধান তুলে নিয়েছেন নিজেদের গোলায়।
সারিয়াকান্দির ফুলবাড়ী ইউপির চেয়ারম্যান আনোয়ারুত তারিকের সেচ স্কিম এলাকায় যে কৃষক ১০০ আঁটি ধান ঘরে তুলেছেন, তাঁর কাছ থেকে ১৫-২০ আঁটি সেচখরচ বাবদ আদায় করা হয়েছে। ওয়াজেদ হোসেন নামের এক কৃষক বলেন, ‘চিয়ারম্যানের ডিপত ৭০ শতক বোরো আবাদ করিচি। ধান বাম্পার হলেও শতকরা ১৫ আঁটি সেচের দাম দেওয়া লাগিচে। সেই হিসাবে বিঘায় (৩৩ শতাংশে) দেড় হাজার টেকা সেচ খরচ দিতে হচে।’
আনোয়ারুত তারিক বলেন, ‘এ ইউনিয়নে সেচের বিনিময়ে ধান নেওয়ার প্রথা বন্ধ করতে জেহাদ ঘোষণা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ছোট ভাই নলকূপ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ায় তা আর বাস্তবায়ন করতে পারিনি।’
সোনাতলার কৃষকেরা জানান, সেচের বিনিময়ে গভীর নলকূপের মালিকেরা খেতের চার ভাগের এক ভাগ ধান নিয়ে নেন। আর অগভীর নলকূপ মালিকদের তিন ভাগের এক ভাগ দিতে হয়। হিসাব কষে দেখা গেছে, বিঘাপ্রতি গড়ে দুই হাজার টাকার ধান যায় নলকূপ মালিকদের ঘরে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন: বগুড়া বিএডিসির (সেচ) নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সেচ স্কিম এলাকার কৃষকেরা যাঁকে মনোনয়ন দিয়েছেন, তাঁকেই ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। আর সেচখরচ নির্ধারণের দায়িত্ব সেচ কমিটির। টাকার বদলে ধান উঠানো হয়ে থাকলে, সেটা সেচ কমিটিরই দেখার কথা।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে সাংসদ আবদুল মান্নান বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করে বিএডিসির ওই প্রকল্প এনেছিলাম। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, গভীর নলকূপের জন্য যাঁরা আমার কাছে এসেছেন, তাঁদেরই সুপারিশ করেছি। আমার সুপারিশের কারণে দলীয় লোকজন এসব নলকূপ বরাদ্দ পেয়েছেন—এমন ধারণা ঠিক নয়।’
জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেচখরচের নামে কৃষকের কষ্টে ফলানো ধান নেওয়াটা বড় ধরনের অন্যায় ও অমানবিক। উপজেলা সেচ কমিটিগুলো অকার্যকর থাকার কারণেই নলকূপ মালিকেরা এ ধরনের কাজ করতে পারছেন। কৃষকেরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে নলকূপ মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.