ঋতু বৈচিত্র্যে বেদনা মধুর বর্ষা, সুরের তরী কতো কথা কতো গান...-বর্ষায় বাংলার প্রকৃতি by সমুদ্র হক

বর্ষা কতটা বেদনার, কতটা মধুর আর কতটাইবা রোমান্টিকতার! সেই বাল্মীকি থেকে কালিদাস হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাঙালীর ঋতু বৈচিত্র্যে কতই না বর্ণনা ও আবেদন এসেছে। সব ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথই বর্ষা প্রকৃতির মানব-মানবীর পূর্ণ প্রতিমা তৈরি করেছেন। যেখানে অকারণে চোখের জলও ভাললাগার কারণ হয়ে ওঠে।


বাংলা কাব্যে সাহিত্যে সঙ্গীতে বর্ষাকে নিয়ে যত গান যত কবিতা যত গল্প উপন্যাস যত রোমান্টিকতা আছে অন্য কোন ঋতুকে নিয়ে ততটা নেই। বর্ষার প্রথম দিনের বারিধারায় অবগাহনে যে আবেগ মানব-মানবীর হৃদয়ে গেঁথে যায় তা পুঞ্জীভূতই হয়ে থাকে। বর্ষার এই ধারায় গীতিকারদের কথায় কতই না সুর তুলেছেন সুরকাররা। সতীনাথের কণ্ঠে “এলো বরষা যে সহসা মনে তাই রিমঝিমঝিমরিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই...”, মান্না দের কণ্ঠে “ওগো বরষা তুমি ঝরো নাকো এমন করে.....” গানে প্রেমিকার পথ চেয়ে বসে থাকা প্রেমিক বৃষ্টিকে না আসার আহ্বান জানিয়েই বলে প্রেমিকা কাছে এলে যেন অঝোরধারায় ঝরে যেন যেতে চেয়েও যেতে না পারে। হেমন্তের কণ্ঠে “তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো...” গানের ছন্দে কতই না মধুময়তা। তালাত মাহমুদের কণ্ঠে “এই রিম ঝিম ঝিম বরষা হাওয়া হিম হিম হিম পরসা তুমি এলে আজ মনে সহসা পথ চলিতে তাই ভরসা...” গানে হৃদয় বীণায় অনুপ্রেরণাই জেগে ওঠে। সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে “বরষারও প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয় সেদিন তাহার সাথে কর পরিচয়, কাছে কাছে থেকেও যে তবু কাছে নয়...” গানে রোমান্টিক ছন্দের তালে বৃষ্টির শব্দে প্রেমিক যায় এগিয়ে। আধুনিক গানের এই ধারার বহু আগে বর্ষার কাব্য ধারায় মহাজন কবি বিদ্যাপতি গোবিন্দ দাস, চ-ী দাস মেঘবৃষ্টির অনুষঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতাকে মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ আরও এগিয়ে গিয়ে মেঘকে ছুঁয়েছেন অন্তরঙ্গ রঙে। সেই রঙের মধ্যেই এনেছেন প্রেয়সীর মিলনের ব্যাকুলতা যেখানে মেঘ মাদলের সুরে রাধার মনে পড়ে কৃষ্ণকে। সেই আবেগে ঝড়ের বৃষ্টিতে ভিজে তমালকুঞ্জের ভেতর দিয়ে ছুটে যায় নীপবনে কৃষ্ণের কাছে। রাধার আবেগের গতি যেন বৃষ্টির ধারাকে তুচ্ছ করে দেয়। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ প্রেমব্যাকুল নারীর প্রেমিকের কাছে ছুটে চলাকে আরও আপন ও অন্তরঙ্গ করে দেখেছেন। তাঁর গানে এসেছে “এসো শ্যামল সুন্দর আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে...।” বহু যুগে অনেক কবির বেদনা পরিণতি পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে। কালিদাসের বর্ণনায় রেবা নদীর তীরে বর্ষার দিনে মালবিকা প্রতীক্ষায় তাকিয়েছিল পথের দিকে প্রিয়তম আসবে বলে। সেই বেদনা একালের ঘাটে এসেও ঠেকেছে কাল পরম্পরায় বর্ষার গানে “বহুকালের ওপার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে....।” বাংলার আকাশে যেভাবেই বর্ষা আসুক তার সত্তাকে ঘিরে আছে বাস্তবতায় মানব-মানবীর জেগে ওঠার সংগ্রামের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করার আহ্বান। বর্ষায় নদ-নদী ফুলে-ফেঁেপ উঠে রুদ্ররূপ ধারণ করার সঙ্গেই নদী তীরের মানুষ জেগে ওঠে নিজেদের রক্ষায়। মাটির বাঁধও যখন রক্ষা করতে পারে না তখন মানব জীবনের সঙ্গে পশুপাখির জীবন রক্ষার তাগিদও মানবিক গুণাবলীতে যোগ হয়। কে আপন কে পর তা মুছে যায়। স্রোতের তীব্র ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকার বৈঠা ঠেলে পাড়ি দেয় শুকনো ভূমির আশ্রয়ে। সেখানে অস্তিত্বের লড়াই মুখ্য। ভালবাসার বন্ধনে একাকার হয়ে যায় মানুষ। বর্ষার সজল মেঘের গভীর কালোয় এক অরুণ আলোর দেখা পায় মানুষ চিত্ত তখন হারিয়ে যায় মেঘের ভেতর। না বলা এই কথাগুলো বাংলার বর্ষার আলাদা সুরে এসেছে নিবিড় অনুভবে। বেদনার্ত এমন আলেখ্যের মধ্যেই মানুষ নিজেদের ছন্দেই এগিয়ে যায়। একটা সময় দেশে নির্ধারিত সময়েই বর্ষা এসে কিছুটা সময় থেকে চলে যেত। জলবায়ুর পরিবর্তনের পালায় বর্ষা এখন খেই হারিয়ে ফেলেছে। গত তিন বছর দেশে বর্ষা তেমন ছিল না। এবার আষাঢ়ের মধ্যভাগে বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে দেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে আবহাওয়াবিদগণ বলছেন, বর্ষার সেই ঢল কমে গেছে। আগামী দিনই বলে দেবে এই আভাস কতটা মিলে যায়! তবে হালে বিশ্বের অনেক জায়গায় বন্যার তীব্রতা বেড়েছে। বর্ষায় বন্যার অনুষঙ্গ যাই থাক বৃষ্টির সুর মানব-মানবীর হৃদয়ে আরেক অনুভবতা এনে দেয় যা মধুছন্দে নেচে ওঠে। এই ছন্দ টের পাওয়া যায় গ্রামের পথে পা বাড়ালে। গ্রামে টিনের চালা ঘরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ধ্রুপদ সঙ্গীতের তালে এনে দেয় আবেশ। আঙ্গিনা রাস্তা মেঠোপথ নদীর তীর বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে বেড়ানো সে আরেক অনুভবতা। তবে হালে বজ্রপাতের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সেই অনুভবে ভাটা পড়েছে। বর্ষার পানি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গেই গ্রামের কিশোররা ঠেলা জাল নিয়ে মাছ ধরতে নামে। কিশোর-কিশোরী হাঁটু পানি পেরিয়ে যায় এ বাড়ি ও বাড়ি। তরুণরা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ঘুর বেড়ায় নদীতে ও ঢলে আসা পনিতে। গ্রামীণ জীবনে বর্ষার এমন ধারার মধ্যে মানুষ খুঁজে নেয় জীবনের অর্থ। আগের দিন যেখানে ছিল শুকনো সড়ক রাতভর বৃষ্টিতে পরদিন সেই সড়ক ডুবে গেলে বর্ষার ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। অপেক্ষায় থাকে কখন নেমে যাবে এই পানি। গ্রামীণ জীবনের এই ধারার পাশাপাশি শহুরে জীবন আরেক ধারার। দেশের বড় শহরগুলোতে বৃষ্টি এনে দেয় যন্ত্রণার দুর্ভোগ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বৃষ্টি হলেই ভোগান্তির মাত্রা যায় বেড়ে। খ-কালীন বন্যার রূপ নেয় মহানগরী। স্তব্ধ হয়ে পড়ে সব কিছুই। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম বন্ধুর পথের মতো। তবু থেমে থাকে না জীবন। বর্ষার এমন জীবনেই মানুষের পথচলা। যেখানে মেঘ মাদলের পাল তুলে আসে বর্ষার সুরের তরী....।

No comments

Powered by Blogger.