ব্লাডব্যাংক-হাত বাড়ালেই বন্ধু by শিহাব জিশান

হঠাৎ একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেন মেহজাবিন মিতুল। তাঁকে বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে দুই ব্যাগ বি নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। এমন চরম বিপদের মুহূর্তে তাঁর আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিতজন কারও সঙ্গেই মিলছিল না রক্তের গ্রুপ।


মিতুলের ছোট ভাই শাহনেওয়াজ একবার হাসপাতালের পাঁচতলায় ওঠেন, পরক্ষণেই নামেন নিচতলায়। প্রায় আধঘণ্টা এভাবে দৌড়ঝাঁপ করার পর রক্ত পেলেন সন্ধানীতে। সেই রক্তে বাঁচল মিতুলের জীবন।
বিপদের দিনে পরম বন্ধুর মতো এভাবে বহু রোগীকে রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে সন্ধানী। একসময় বিনা মূল্যে রোগীদের জরুরি রক্ত সরবরাহের কাজটি একাই করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। তবে এখন নগরে আরও কয়েকটি সংগঠন এমন সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে।
সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিট: সন্ধানী চমেক ইউনিটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮২ সালের ২ ডিসেম্বর। বিভিন্ন সময়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি আয়োজনের মধ্য দিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে সন্ধানী। সন্ধানী থেকে রক্ত সংগ্রহ করা যায় বিনিময় পদ্ধতিতে। যিনি রক্ত নিয়ে যান, তাঁকে যেকোনো গ্রুপের সমপরিমাণ রক্ত জমা দিতে হয়। যদি রোগীর স্বজনদের মধ্যে রক্ত বিনিময় করার মতো কেউ না থাকে, তাহলে জরুরি প্রয়োজনে সেই বিষয়টিও শিথিল করা হয়।
এ বছরের ২৮ জুন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করেছে সন্ধানী চমেক ইউনিট। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সন্ধানীর রয়েছে ৪০০ ব্যাগ রক্তের ধারণক্ষমতার উপযোগী একটি রেফ্রিজারেটর। এই রেফ্রিজারেটরে সাধারণত ২১ দিন পর্যন্ত রক্ত রাখা যায়। রক্ত সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন এলাকায় এ বছর আরও প্রায় ১০০টির মতো অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সন্ধানীর সদস্যরা। তবে চাহিদা অনুসারে রক্ত সংগ্রহ না হওয়ায় প্রতিবছর চট্টগ্রামে রক্তের ঘাটতি হচ্ছে বলে জানালেন সন্ধানী চমেক ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক বুদ্ধদেব সরকার। তিনি বলেন, ‘দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সন্ধানী সেবা দিচ্ছে রোগীদের। অনেকের ধারণা, সন্ধানী রক্ত বিক্রি করে। এ ধারণা পুরোপুরি ভুল। রক্ত দেওয়ার সময় রক্তের স্ক্রিনিং খরচ (রক্তে জীবাণু আছে কি না, তাঁর পরীক্ষা) বাবদ ২০০ টাকা নেওয়া হয়।’ সন্ধানী চমেক ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে ০৩১ ৬১৬৬২৫ নম্বরে।
ফাতেমা বেগম রেড ক্রিসেন্ট রক্তকেন্দ্র: বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পরিচালিত ফাতেমা বেগম রেড ক্রিসেন্ট রক্তকেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালের ৭ জুন। কোনো রোগী রক্তের অভাবে মৃত্যুবরণ করবে না—এই লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠন। বাংলাদশ যুব রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম ইউনিটের রক্ত বিভাগের প্রধান অভিজিৎ মজুমদার বলেন, ‘সংগৃহীত রক্তের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় কম। এ রক্তকেন্দ্রের রেফ্রিজারেটরে প্রায় ৩০০ ব্যাগ রক্ত ৩৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। রক্তকেন্দ্রটি খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা।’ এই সংগঠনের সঙ্গে ফোনে (০৩১ ৬২০৯২৬) যোগাযোগ করা যাবে।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম: সন্ধানী কিংবা রেড ক্রিসেন্টের মতো কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনও রোগীদের রক্তের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে। এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে রোগীদের জরুরি রক্ত সরবরাহ করে থাকেন। বর্তমানে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের তালিকাভুক্ত রক্তদাতার সংখ্যা এক হাজার ৭৪০ জন। যে কেউ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে রক্তের জন্য আবেদন করতে পারেন। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে যোগাযোগ করতে হবে। এ ছাড়া রক্ত সংগ্রহের জন্য চিকিৎসকের ছাড়পত্র (রিকুইজিশন স্লিপ) ও রোগীর রক্তের নমুনা সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়। এখানে কোনো ধরনের ফি নেওয়া হয় না। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মুঠোফোনে (০১৮৩৬ ৪৫৮৬৯৯) যোগাযোগ করে বিস্তারিত জানা যাবে।
এখন সময়: রক্তদাতা তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করছে ‘এখন সময়’। ২০১১ সাল থেকে সংগঠনটি এমন সেবামূলক কাজ করছে। গ্রহীতার প্রয়োজনে যোগাযোগ করা হলে এ সংগঠনের রক্তদাতারা বিনা মূল্যে রক্ত দিয়ে আসেন। বর্তমানে এ সংগঠনের তালিকাভুক্ত রক্তদাতার সংখ্যা ৫৬৩ জন। যে কেউ ২৪ ঘণ্টা বিনা মূল্যে রক্তের জন্য এ সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। এখন সময়ের মুঠোফোন নম্বর : ০১৮১৭ ০৪৬৭৬৫।
রক্তদাতা: ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে রক্তদাতা নামের সংগঠনটি। বর্তমানে এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ২৬০ জন, যাঁরা বিনা মূল্যে অন্যের প্রয়োজনে রক্ত দেন। এ সংগঠনের পরিচালক ফিরোজ আলম বলেন, ‘স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি আমরা।’ ২৪ ঘণ্টা এ সংগঠনের সঙ্গে বিনা মূল্যে রক্তের জন্য যোগাযোগ করা যাবে। রক্তদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে ০১৭১১ ৪৮১২৮৬ নম্বরে।
রক্তে জীবন, রক্তে মরণ!: বিশুদ্ধ রক্ত জীবন বাঁচায় কিন্তু দূষিত রক্ত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় মানুষকে। তাই রক্তদাতা ও রক্তগ্রহীতা দুজনকেই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। রক্তদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে হতে হবে। ওজন হতে হবে কমপক্ষে ৪৫ (মহিলা) ও ৪৮ (পুরুষ) কেজি। রক্তদাতা সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে গ্রহীতা রক্তবাহিত বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রক্ত নেওয়ার আগে সেই রক্তে এইডস, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিসের জীবাণু আছে কি না, তা পরীক্ষা করা উচিত। এ প্রসঙ্গে সন্ধানী চমেক ইউনিটের উপদেষ্টা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘দূষিত রক্ত গ্রহণে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে পারে। আর এর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া হয় আরও ভয়ংকর।’

No comments

Powered by Blogger.