নতুন ঠিকানা এখন চীন

বিশ্বমানের অনেক কোচ ও তারকা ফুটবলারেরই ঠিকানা এখন চীন। লিখেছেন খলিলুর রহমান জনসংখ্যায় চীন বিশ্ব মুরব্বি। আয়তনেও খুব পিছিয়ে নেই। অর্থনৈতিকভাবেও চীনারা তরতর করে উঠছে ওপরের দিকে। পারমাণবিক শক্তি, ক্ষমতার দাপট সব মিলিয়ে এক কথায় চীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি।


এমনকি অলিম্পিকেও চীনাদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিষয় যদি হয় ফুটবল, বিশ্ব মানচিত্রে চীনারা কিনা অস্পষ্ট এক বিন্দু! কোথায় তাদের স্থান, ঠিক যেন চীনাদেরও অজানা!
বিশ্ব তো বিশ্ব, এশিয়া মহাদেশেও চীনারা ফুটবল পরাশক্তি হিসেবে মাথা তুলতে পারেনি। একবারই মাত্র খেলেছে বিশ্বকাপ। ২০০২ সালে কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করার পর খবর নেই তাদের। আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষে শিল্প-সাহিত্য-গবেষণাসহ অন্য সব বিষয়ে ক্রমেই যাদের ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বে ছুটে চলা, সেই চীনাদের কি ফুটবলে এভাবে মাথা ডুবিয়ে থাকলে চলে! দেরিতে হলেও ফুটবল জাগরণের পথে নেমেছে তারা। বিশ্ব ফুটবলের খোঁজখবর যাঁরা নিয়মিত রাখেন, তাঁরা এরই মধ্যে জেনে গেছেন, সম্প্রতি চীনা সুপার লিগ (সি-লিগ) বিশ্ব দরবারে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশের ফুটবল আলোচনায় এসেছে একটু অন্যভাবে, বিশ্বের তারকা কিছু ফুটবলার আমদানির মাধ্যমে। কয়েক বছর আগেও যা ভাবা যায়নি, এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে চীনে। নিকোলাস আনেলকা, দিদিয়ের দ্রগবার মতো স্ট্রাইকাররাও নাম লিখিয়েছেন চীনা সুপার লিগে।
ইউরোপের গরম প্রতিদ্বন্দ্বিতার পড়ন্ত বেলার যাত্রী ‘তারকাখচিত’ তারকাদের দলে টেনে মাঝেমধ্যেই আলোচনায় এসেছে মেজর লিগ সকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের ক্লাবগুলো। এই তালিকায় আছে রাশিয়ার আনঝি মাখাচকালাও। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সুদূরপ্রসারী একটা পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নেমেছে চীন। যার লক্ষ্য একটাই, ভবিষ্যতের ফুটবল পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
চীনের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার প্রতিফলন সে দেশের ফুটবল ক্লাবগুলোতেও। যার কারণেই তারকা খেলোয়াড়দের দলে টানতে দুহাতে অর্থ ঢালতে পারছে তারা। উদাহরণ হিসেবে গুয়াংজু এভারগ্রান্ডের কথা বলা যায়। দলের শক্তি বৃদ্ধিতে ইতিমধ্যেই তারা দলে ভিড়িয়েছে দুবারের ব্রাজিলিয়ান লিগের সেরা খেলোয়াড় দারিও কনকা এবং বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের সাবেক স্ট্রাইকার লুকাস ব্যারিওসকে। সুপার লিগের আরেক দল সাংহাই শেনহুয়ার চমকটা আরও বড়। গত জানুয়ারিতেই চেলসি থেকে তারা দলে টেনেছিল ফরাসি স্ট্রাইকার নিকোলাস আনেলকাকে। এবার টানল চেলসির আরেক স্ট্রাইকার আইভরি কোস্টের দিদিয়ের দ্রগবাকে। ইউরোপ-সেরা দল চেলসি ছেড়ে কেন চীনে পাড়ি জমালেন দ্রগবা, এই প্রশ্নটা উঁকি দিচ্ছে যাঁদের মনে, তাঁদের জ্ঞাতার্থে সাংহাই শেনহুয়ায় দ্রগবার সাপ্তাহিক পারিশ্রমিকটা জানিয়ে দিই—৩ লাখ ১৫ হাজার মার্কিন ডলার!
তুলনামূলকভাবে অখ্যাত সুপার লিগের দল হেনান কনস্ট্রাকশনও চীনের বাইরের তারকা আমদানিতে সক্রিয়। আফ্রিকান নেশনস কাপের শিরোপা জিতে চমক উপহার দেওয়া জাম্বিয়ার অধিনায়ক ক্রিস্টোফার কাতোঙ্গোকে এ বছরই দলে টেনেছে তারা। সাংহাই শেনহুয়াই বলুন কিংবা হেনান কনস্ট্রাকশন, সবারই লক্ষ্য একটাই—ভালো খেলে নিজেদের অবস্থান পাল্টে ফেলা। সেটা করতে পারলে এমনিতেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে চীনা সুপার লিগ।
ফ্রেডেরিক কানুটেও নাম লিখিয়েছেন সুপার লিগে। ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগে টটেনহাম হটস্পার ও ওয়েস্টহামে খেলা মালিয়ান কানুটে চীনে পাড়ি দেওয়ার আগে খেলেছেন স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ায়। ৩৪ বছর বয়সী কানুটে যোগ দিয়েছেন বেইজিং গোয়ানে। ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের ইয়াকুবু আইয়েগবেনি ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছেন চীনা সুপার লিগকে। গুয়াংজু ফুলিতে যোগ দিয়েছেন এই নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার।
শুধুই কি ফুটবলার, কোচ আমদানিতেও চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন চীনা সুপার লিগে। ১৩টি ক্লাব এরই মধ্যে ভিন্ন ১০ দেশ থেকে কোচ ও ম্যানেজার নিয়োগ দিয়েছে। যাঁর তিনজনের আবার আছে বিশ্বকাপে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা। প্রথমেই বলা যায় জাপানি কোচ তাকেশি ওকাদার কথা। এ বছরই হাংজু গ্রিনটাউনের দায়িত্ব নিয়েছেন জাপানকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া কোচ। কোস্টারিকার আলেক্সান্দ্রে গুইমারেস সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছেন তিয়ানজিন তেদার। তবে সবচেয়ে বড় চমকটা দিয়েছে গুয়াংজু এভারগ্রান্ডে। গত মাসে তারা কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ইতালিকে বিশ্বকাপজয়ী কোচ মার্সেলো লিপ্পিকে।
বিষয়টাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছে চীনের ফুটবল মহল। চীন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (সিএফএ) সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মি. উই ডি যেমন বলছেন, ‘এসব বিশ্বমানের কোচ এবং খেলোয়াড়ের আমদানিতে ক্লাবগুলোয় টেকনিক্যাল এবং ট্যাকটিক্যাল উন্নতি আসবে।’ ৫৭ বছর বয়সী ফুটবল সংগঠক উই ডি এর পরই বলেছেন আসল কথাটা, ‘এভারগ্রান্ডে ও শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য ক্লাব এটা প্রমাণ করেছে। তাই সিএফএ মানসম্পন্ন খেলোয়াড় ও কোচ ক্রয়কে উৎসাহিত করে। এতে শুধু সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলোই লাভবান হবে না, চীনের ফুটবলকে দীর্ঘ মেয়াদে এগিয়ে নিতেও তা সাহায্য করবে।’
চীনা ফুটবলের পতাকাতলে যাঁরা সমবেত হচ্ছেন তাঁদের মুখেও দেশটির ফুটবল জাগরণের প্রতিশ্রুতি। দ্রগবা যেমন বলছেন, ‘আমি সেখানে আরও বেশি মানুষকে খেলাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাই। এবং আমি চাই চীনের সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করতে। আমি মনে করি, ভবিষ্যতের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ চীনের জন্য বোধহয় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ!

No comments

Powered by Blogger.