উত্তাল ২০০৯ সালের ঘটনাধারা by উত্তম চক্রবতর্ী

বছর আসে, বছর যায়। কিন্তু বেশ কিছু ঘটনা থেকে যায় আলোচনার শীর্ষে। তেমনি কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ঘটনাবহুল একটি বছর ২০০৯। দীর্ঘ অগণতান্ত্রিক শাসন থেকে এ বছর জনগণের রায়ে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার। অসাংবিধানিক শাসন থেকে দেশের মানুষ প্রবেশ করে সাংবিধানিক শাসনে।


ভূমিধস বিজয় নিয়ে মতায় আসা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের এক বছরের সফলতা বা ব্যর্থতার ব্যারোমিটার যাচাইয়ের উপযুক্ত সময় না হলেও এই ১২ মাসে বেশ কিছু ইসু্য ছিল বছরজুড়েই আলোচনা সমালোচনার শীর্ষে।
ঘড়ির কাঁটা বছরে দু'বার বদল
বিদায়ী বছরে সরকারের একটি সিদ্ধান্ত শেষ দিন পর্যন্ত আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। আর তা হলো দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বিদু্যত সঙ্কট উত্তরণে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে আনা। বছরের মাঝামাঝিতে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে আনার মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। বছরের অন্যতম এই বিষয়টি শুরুতে সাড়া জাগালেও বছরের শেষ দিকে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে আনা বা ডিজিটাল টাইমের এক অম্লমধুর অভিজ্ঞতা লাভ করে বাংলাদেশের মানুষ। তবে বছরের শেষভাবে সরকার পহেলা জানুয়ারি থেকে আগের নিয়ম অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা পেছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদু্যত সাশ্রয়ের ধারণা থেকে বিদায়ী বছরের ১ জুন ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। ১৯ জুন সারাদেশের ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে নেয়া হয়। টার্গেট দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ মেগাওয়াট বিদু্যত সাশ্রয় করা। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে ১ জানুয়ারি থেকে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা পিছিয়ে সময় আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো ঘড়ির কাঁটা বছরে দু'বার এক ঘন্টা এগোনো ও পেছানো হবে। সে হিসাবে ৩১ মার্চ ঘড়ির কাঁটা আবার এক ঘন্টা এগিয়ে দেয়া হবে। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এভাবে সময় নির্ণিত হবে। আবার ১ নবেম্বর থেকে এক ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হবে। এ অবস্থা থাকবে ১ এপ্রিল পর্যন্ত। এভাবেই নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেই নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে আবার আগের সময়ে ফিরে যাবে দেশ।
খালেদা জিয়ার বাড়ি
বিদায়ী বছরে আলোচনার ঝড় তুলেছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামে অবৈধভাবে বরাদ্দকৃত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের ৯ বিঘার ওপর নির্মিত বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের ইসু্যটি। মহাজোট সরকার মতায় আসার পর সেনানিবাসের মতো সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও সংরতি এলাকাকে রাজনীতিমুক্ত করতে এই সাহসী পদপেটি নিয়েছিল। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার জন্য ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের দেয়া নোটিসের কার্যকারিতা স্থগিত করায় সরকারের সিদ্ধান্তটি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বিদায়ী বছরের ৮ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের সভায় খালেদা জিয়ার নামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৯ বিঘার ওপর নির্মিত বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তে বলা হয়, 'লিজের নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যক্তিকে একাধিক বাড়ি বরাদ্দ দেয়া যায় না। যেহেতু ১৯৮১ সালে খালেদা জিয়াকে একটি (৯ বিঘার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি) এবং ১৯৮২ সালে আরেকটি (দেড় বিঘা, গুলশানে) বাড়ি দেয়া হয়, তাই সরকার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটির বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।' সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রেেিত ২০ এপ্রিল আগামী ১৫ দিনের সময় দিয়ে খালেদা জিয়াকে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ছেড়ে দেয়ার জন্য নোটিস দেয় সামরিক ভূমি ও সেনানিবাস অধিদফতর। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি হয়। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতির মাঠ। কিন্তু রাজপথে সুবিধা করতে না পেরে খালেদা জিয়ার বাড়ি রায় আদালতে যান বিএনপি।
টিপাইমুখ ড্যাম
বিদায়ী বছরজুড়েই আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে ছিল ভারতের টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ ইসু্য। যা নিয়ে এখনও একটি চিহ্নিত মহল রাজনৈতিক ইসু্য বানাতে মরিয়া। বর্তমান সরকার মতা গ্রহণের পর থেকেই এই ইসু্যতে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলেছে এবং চলছে নানা কায়দায়। বছরের শেষ ভাগেও ওই মহলটি টিপাই ড্যাম ইসু্যতে আন্দোলন, লংমার্চ, হরতাল কর্মসূচী পর্যন্ত পালন করেছে। বাংলাদেশের উজানে ভারতে টিপাইমুখ ড্যাম জলবিদু্যত প্রকল্প নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা। সরকার অনেক দতার সঙ্গেই কূটনৈতিক তৎপরতায় ইসু্যটির অনেকাংশে সমাধান করতে সম হয়। বিষয়টি নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে, তখন মিসরের শার্ম আল শেখে অনুষ্ঠিত ন্যাম সম্মেলনের বাইরে সাইড লাইনে বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে ইসু্যটি নিয়ে সফল আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে ভারত প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের তি হবে এমন কোন কাজ করবে না ভারত।' এখানেই শেষ নয়, সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ ড্যাম এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদু্যতমন্ত্রী বারবার নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পের আওতায় কোন সেচ কম্পোনেন্ট নেই এবং ড্যামের বাটিতে ফুলেরতল বা অন্য কোন স্থানে ব্যারাজ অথবা পানি প্রত্যাহারমূলক অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে না।
সোয়াইন ফু
দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরে ২০০৯ সালের অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল সোয়াইন ফু আতঙ্ক। সোয়াইন ফু নিয়ে গত ৭ মাসে হয়েছে বহু রকমের খেলা। জীবন বাঁচানোর চেষ্টার অজুহাতে হয়েছে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য। সোয়াইন ফু ভাইরাস গত এপ্রিলে মেক্সিকোয় প্রথম ধরা পড়লেও বাংলাদেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় জুন মাসে। এত দ্রুত মেক্সিকো থেকে এই ভাইরাস বাংলাদেশে সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টি সবাইকে অবাক করে দেয়। এরপর থেকেই সোয়াইন ফু নিয়ে বাংলাদেশে ঘটতে থাকে একের পর এক আতঙ্ক সৃষ্টির ঘটনা। এ সুযোগটা লুফে নেয় একশ্রেণীর বাণিজ্যিক সুবিধাভোগীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমন বক্তব্যকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউশন। এই প্রতিষ্ঠানটি কয়েক মাসের ব্যবধানে দেশে ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ সোয়াইন ফুতে আক্রান্ত হবেন বলে জাতিকে আগাম বার্তা পেঁৗছে দেয়। এভাবে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির সিদ্ধান্ত ও বক্তব্যের ওপর ভর করে আতঙ্কের দৌড় যেন ভাইরাসের সংক্রমণ গতিকেও হার মানিয়ে দেয়। সরকারী হাসপাতালগুলোতে গড়ে ওঠে 'সোয়াইন ফু কর্নার'।
পার্বত্য এলাকায় সেনা প্রত্যাহার
বিদায়ী বছরে আরেক আলোচিত ঘটনা ছিল পার্বত্য এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহারের সাহসী পদপে। শান্তিচুক্তির একযুগ পর বিদায়ী বছরের ২৯ জুলাই এ সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চল থেকে একযোগে বড় ধরনের সেনা প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটে। পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থানরত সেনা ক্যাম্প থেকে একযোগে ৩৫টি নিরাপত্তা ক্যাম্প এবং তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নসহ একটি সম্পূর্ণ একটি ব্রিগেড প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। বিগত বছরগুলোর তুলনায় বিদায়ী বছরেই সর্ববৃহৎ ও উল্লেখযোগ্য অংশ সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয় পাবর্ত্য অঞ্চল থেকে।
শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের এমন দৃঢ় পদেেপ আলোচনার ঝড় ওঠে। বিরোধী দল সরকারের এই পদেেপর তীব্র সমালোচনা করে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দুটি পৃথক রিট আবেদন করা হলে ১৬ আগস্ট সেনা প্রত্যাহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। চারদিন পর একই বেঞ্চের বিচারপতিদ্বয় পাবর্ত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিলে আইনি জটিলতা দূর হয়। গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিতিশীলতা
বিদু্যত সঙ্কট
বিদু্যতের মহাসঙ্কট নিয়ে মতায় আসে বর্তমান মহাজোট সরকার। শত শত কোটি টাকা খরচ দেখানো হলেও বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছর আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু'বছর মিলিয়ে সাতটি বছর বিদু্যত উৎপাদন হয়নি বললেই চলে। অথচ চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। বর্তমানে ৫৫০০ মেগাওয়াট বিদু্যতের চাহিদা থাকলেও উৎপাদিত হচ্ছে ৩৭ থেকে ৩৮শ' মেগাওয়াট। বিদু্যত আসা-যাওয়ার ভেল্কিবাজির মধ্যে সরকার মতায় এসে বিদায়ী এক বছরে কিছুটা হলেও জনগণের ভোগান্তি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। দিনের আলো সাশ্রয় করে বিদু্যত বাঁচাতে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা পর্যন্ত এগিয়ে আনতে হয়েছে সরকারকে। সন্ধ্যার পর দোকানপাট-শপিংমল বন্ধ রেখে কিছু মানুষের সমালোচনাও শুনতে হয়েছে সরকারকে। তবে বিদু্যতখাতের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে বিদেশে রোড শো'র আয়োজনও ছিল বিদায়ী বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম।

No comments

Powered by Blogger.