বদলে যাও বদলে দাও মিছিলটেলিভিশন সংলাপ-সড়ক দুর্ঘটনা কি চলতেই থাকবে

প্রথম আলো ও দেশ টিভির যৌথ টেলিভিশন সংলাপ অনুষ্ঠান ২৯ মে দেশ টিভিতে সম্প্রচারিত হয়েছে। এই সংলাপে সহযোগিতা করেছে বিএসআরএম। ‘বদলে যাও বদলে দাও মিছিল’-এর উদ্যোগে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে নির্মিত অনুষ্ঠানটির আলোচকদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত, সুপারিশ ও প্রতিশ্রুতিগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে আজ ছাপা হলো।


যাঁরা অংশ নিলেন
ওবায়দুল কাদের
যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী
ডক্টর সামছুল হক
অধ্যাপক পুরকৌশল বিভাগ ও সাবেক
পরিচালক, সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা
ইনস্টিটিউট, বুয়েট
ইলিয়াস কাঞ্চন
অভিনেতা ও সভাপতি
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন
আমিনুর রহমান লস্কর
প্রধান প্রকৌশলী, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর
আইয়ুবুর রহমান খান
চেয়ারম্যান, বিআরটিএ
ডাক্তার ফজলুর রহমান
নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর ইনজুরি
প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ
মহাসচিব, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি
ডাক্তার কামরান উল বাসেত
জাতীয় সমন্বয়কারী, সেন্টার ফর ইনজুরি
প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ
মাহমুদুজ্জামান বাবু
কণ্ঠশিল্পী ও সমাজকর্মী
রনি সরকার
বদলে যাও বদলে দাও মিছিল ব্লগ লেখক
মাসুদ খান
বদলে যাও বদলে দাও মিছিল ব্লগ লেখক
সঞ্চালক
মিথিলা ফারজানা

আলোচনা
মিথিলা ফারজানা: আজ এই অনুষ্ঠানে আমাদের চাওয়া নিরাপদ সড়ক। আমরা সমাধান চাই। আমাদের সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টায় যাঁরা অংশ নিয়ে আমাদের বাধিত করেছেন, আমরা সরাসরি চলে যেতে চাই তাঁদের কাছে। সমস্যাগুলোর সমাধান কী করে সম্ভব, সেই প্রশ্নগুলোর মধ্যে। বাংলাদেশে যেসব সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, সেটি ফুটপাতের অভাবে অথবা মহাসড়কে পথচারীদের চলাচল বা কম গতির যানবাহনের চলাচলের যে রাস্তা, সেটির অভাবের কারণে। ডক্টর সামছুল হক, কী করে এই সমস্যার সমাধান করা যায়?
ডক্টর সামছুল হক: সড়কে নিরীহ পথচারী, সবচেয়ে অরক্ষিত সড়ক ব্যবহারকারী, তাকে কোনো গাড়ি আঘাত করলেই পরিণতি খুব খারাপ হয়। ৫৮ শতাংশ পথচারীই রাস্তায় মারা যাচ্ছে। মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ শতাংশ। পশ্চাতে যে সংঘর্ষটা হয়, সে ক্ষেত্রে ১১ শতাংশ এবং গাড়ি উল্টে রাস্তা থেকে পড়ে গিয়ে আরও ৯ শতাংশ মারা যায়। পথচারীর স্বভাবতই সুরক্ষা থাকে, যখন সে হাঁটে, তখন কিন্তু একটা যানবাহন এসে তাকে আঘাত করতে পারে না। এটাই রীতি। পথচারীর জন্য যে পথটা বরাদ্দ থাকে, সেটা হলো একটা ফুটপাত এবং রাস্তা পারাপার করার জন্য নিম্নতম পর্যায়ে হচ্ছে জেব্রা ক্রসিং এবং উচ্চমানের নিরাপদ হচ্ছে ওভারপাস অথবা আন্ডারপাস। আমরা দেখি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাস্তা পার হতে গিয়ে লোকজন মারা যাচ্ছে এবং বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ মারা যাচ্ছে হাঁটতে গিয়ে।
মিথিলা ফারজানা: দরিদ্র দেশের ক্ষেত্রে মহাসড়কে ফুটপাত দেওয়া একটি ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাহলে কী হতে পারে সমাধান?
ডক্টর সামছুল হক: গ্রামাঞ্চলে যেহেতু ফুটপাত নেই, থাকে রাস্তার ধার (সোল্ডার)। রাস্তার দুই ধারে মাটির যে রাস্তা থাকে, সেখানেই পথচারী চলাচল করার কথা। সেই জায়গায়ও ওভারটেক করার সময় গাড়ি চলে যায়। এ জন্য চলমান একটা রেলিং দিতে হবে। সব জায়গায় ফুটপাত দেওয়া আমাদের দেশের অর্থনীতিতে সমর্থন করা যায় না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। গাড়ি যখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়, তখন দুই লেনের রাস্তায় যদি একটি গাড়ি দাঁড়ায়, তাহলে রাস্তাটা অকার্যকর হয়ে যায়। নিয়মের বাইরে যে গাড়িটা আসবে, সে গাড়িটি রাস্তায় না দাঁড়িয়ে রাস্তার ধারে যেন যেতে পারে। সে জন্য রেলিংটা দেওয়া, কিন্তু এটা নিরাপদ নয়। এ ক্ষেত্রে পথচারী ও চালক উভয়ের সচেতনতা প্রয়োজন। আক্রমণাত্মক ওভারটেকিং করতে গিয়ে গাড়ি সোল্ডারের শেষে চলে যাচ্ছে।
মিথিলা ফারজানা: আমাদের সঙ্গে আছেন সড়ক ও জনপথের প্রধান প্রকৌশলী আমিনুর রহমান লস্কর। রাস্তার ধারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, এটিকে কোনোভাবে সমাধান করা যায় কি না?
আমিনুর রহমান লস্কর: জাতীয় মহাসড়কে আমাদের সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ২৩ শতাংশ। আঞ্চলিক মহাসড়কে ১২ শতাংশ আর স্থানীয় সংযোগ (ফিডার) সড়কে ১৫ শতাংশ। আমরা দেখছি, জাতীয় সড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। সেটা ফুটপাত দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়।
মিথিলা ফারজানা: শহরাঞ্চলের যে ফুটপাত, সেখানে একরকম ইঁদুর-বিড়াল খেলা হয়। মাননীয় মন্ত্রী, ফুটপাত দখলমুক্ত করলে কি ভোট কমে যায়? এটি কি রাজনৈতিক সমস্যা?
ওবায়দুল কাদের: রাজনীতি নেই, আমি সে কথা বলছি না। এ দেশে নির্বাচনী রাজনীতির জন্য অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ফুটপাত দখলের বিষয়টি অবশ্যই এখানে আনা যায়। নিম্ন শ্রেণীর মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে জড়িত। অ্যাজেন্ডা আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমাদের দুর্বল। আমি এটাকে বলব উদ্ধার অভিযান। এখন এটা করতে গেলে দেখা যাবে হয়তো উদ্ধার হয়ে গেছে। এটা কিন্তু সরষের মধ্যে ভূত আর কি!
মিথিলা ফারজানা: দখলমুক্ত করতে গেলে কিছু মহল অসন্তুষ্ট হবে। তার পরও দৃঢ় পদক্ষেপটি নেওয়া দরকার।
ওবায়দুল কাদের: আমি এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত নই। এই পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। ছয় মাসের ভেতর আপনারা আশা করতে পারেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করার একটি পদক্ষেপ আমরা নিতে পারব। কিছু কিছু পরিবর্তনের ছবি দেখতে পাবেন আশা করছি।
মিথিলা ফারজানা: শিশুদের মাঝে এ সম্পর্কে সচেতনতা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে কাজ করেন ডা. কামরান উল বাসেত। আপনার পরামর্শ কী?
ডা. কামরান উল বাসেত: আমরা যখন শিশুকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটব, তখনই কীভাবে পথ চলতে হবে, কীভাবে ফুটপাত ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে রাস্তা পার হতে হবে—এই তথ্যগুলো সরাসরি শিশুদের এবং তাদের পাঠ্যপুস্তকে দিতে পারি। আমরা হয়তো আজ এর ফল পাব না, কিন্তু ১৫ বছর পর আমরা একটা নিরাপদ সড়কসহ একটি সচেতন জাতি পাব।
মিথিলা ফারজানা: মহাসড়কে যে ধরনের সংকেত চিহ্নগুলো চালকদের সচেতন করে, যেমন—সামনে বাঁক, সামনে স্কুল, সামনে হাসপাতাল। এ ধরনের চিহ্নগুলোর যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। মাহমুদুজ্জামান বাবু, আপনি অনেকবার অনুসন্ধানে গিয়েছেন এই সড়কগুলো দিয়ে। কী দেখলেন?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: ফেনী জয়লস্করে একটা ব্রিজের পাশে দীর্ঘ ইউটার্ন আছে। ফেনী শহরে চালকেরা বলেছিলেন, ওই ইউটার্নে তাঁরা যখন পৌঁছান তখন তাঁদের দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি হয়, এর ফলে অনেক সময় তাঁরা রাস্তাটিকে দুটি রাস্তা দেখেন। কারণ, এত দ্রুতগতিতে গাড়িটা চলে এবং এত আচমকা সেতুটি সামনে চলে আসে যে সবাই ভয় পায়। কিন্তু ওই জায়গায় কোথাও কোনো সংকেত নেই। আমরা পরে ফেনী সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলছেন, ‘এ রকম হয়েছে, এটা তো আমার আসলে জানা নেই। আমাকে বিষয়টি দেখতে হবে।’
মিথিলা ফারজানা: প্রকৌশলী আমিনুর রহমান লস্কর। কখন আমরা দেখব প্রতিটি মহাসড়কে জরুরি চিহ্নগুলো আছে?
আমিনুর রহমান লস্কর: অনেক জায়গায় সংকেতগুলো পোস্টার দিয়ে ঢেকে দেওয়া আছে বা কেউ বাঁকা করে দিয়ে গেছে। যেখানে চিহ্ন বা সংকেত নেই, অবশ্যই আমরা সেখানে সরবরাহ করব। এটার কোনো গত্যন্তর নেই।
ওবায়দুল কাদের: কেন আমরা এই সংকেত চিহ্নগুলো বসাতে পারি না। এগুলো তো খুব কঠিন কাজ না। আমার মনে হয়, আপনি বলতে পারেন যে আমরা তিন মাসের মধ্যে এগুলো স্থাপন করব।
মিথিলা ফারজানা: সেই সংকেত চিহ্নগুলো বা বার্তাগুলোকে চালকেরা আসলে পড়তে পারছেন কি না, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইলিয়াস কাঞ্চন আপনি বহু দিন ধরে এই প্রয়োজনের কথা বলে আসছেন।
ইলিয়াস কাঞ্চন: প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং দায়িত্ববান চালক যদি তৈরি করা যায়, তাহলে ৭০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে। এই সংকেত চিহ্নগুলো দিলেই চালকেরা যে মানছেন, এটাও কিন্তু নয়। কারণ, অনেক সময় তিনি জানেনও না যে এই সংকেত বা চিহ্নগুলোর মানেটা কী এবং এই জায়গায় তাঁকে কীভাবে গাড়ি চালাতে হবে। বিষয়গুলো তাঁরা কিন্তু শিখতে পারছেন না। আধুনিকভাবে যে চালক তৈরি করা হয়, ওই ধরনের প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে একেবারেই নেই। সচেতনতার কথা যে আমরা বলছি, সচেতনতা কী? আমি যদি না-ই জানি যে আমাকে কীভাবে গাড়ি চালাতে হবে, তাহলে আমি সচেতন হব কী করে।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: আমরা গাজীপুরে বিআরটিসির প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। গাজীপুরের ওই কেন্দ্রটিসহ সারা দেশে ১৮টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। যিনি দায়িত্বে আছেন, তিনি বলেছেন, ‘আমরা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার সক্ষমতা রেখেছি অষ্টম শ্রেণী পাস। কিন্তু সেই শিক্ষাগত যোগ্যতার বেশি লোকজন আমরা পাচ্ছি না।’ পেশাদার যাঁদের লাইসেন্স আছে, তাঁরা কেউই আসলে তেমন শিক্ষিত নন এবং যাঁরা প্রশিক্ষক তাঁদেরও যথেষ্ট পাওয়া যায় না যে প্রত্যেককে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে।
মিথিলা ফারজানা: আমাদের সঙ্গে আছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান। আপনি বলুন, প্রশিক্ষণ শুধু আপনারা বিআরটিএ কেন, বেসরকারি যেসব প্রশিক্ষক আছেন, তাঁদের অনুমোদন দিয়ে এটির সমাধান করা যায় কি না?
আইয়ুবুর রহমান খান: বাংলাদেশে বিআরটিএর নিবন্ধনভুক্ত প্রশিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ৫৪ জন। অথচ প্রতিবছর ৩৪ হাজারের মতো চালক রাস্তায় আসছেন এবং মোটরসাইকেলসহ এর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখের মতো। এই ৫৪ জন প্রশিক্ষক দিয়ে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে দক্ষ পরিচালক বা চালক হিসেবে তৈরি করা সম্ভব নয়।
মিথিলা ফারজানা: কিন্তু এটি বাড়ানোর ব্যবস্থা কী?
আইয়ুবুর রহমান খান: এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সরকারের নিজস্ব ফান্ড নিয়ে প্রশিক্ষক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রশিক্ষক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা ২০ জন প্রশিক্ষককে প্রশিক্ষিত করেছি। আগামী মাসে আরও ২০ জন প্রশিক্ষক তৈরি করব।
মিথিলা ফারজানা: এটির কি কোনো লক্ষ্যমাত্রা আছে, যত জন প্রশিক্ষক দরকার, সেটি এক বছরের মধ্যে আপনারা তৈরি করতে পারবেন?
আইয়ুবুর রহমান খান: লক্ষ্যমাত্রা আছে, এক বা দুই বছরের মধ্যে অন্তত এক হাজার প্রশিক্ষক তৈরি করা সম্ভব হবে। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েক শ প্রশিক্ষক তৈরি করা সম্ভব হবে বলে আশ্বাস দিতে পারি। আরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা শিক্ষা, প্রবাসীকল্যাণ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি, তাদের যে কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোর মাধ্যমে যেন দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ডক্টর সামছুুল হক: প্রশিক্ষক তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা আপাতত রেজিস্ট্রেশনের বাইরে থাকেন। যে ড্রাইভিং স্কুলগুলো আছে তাদের যদি আমরা অনুমোদন দিই এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের আমরা নিয়োগ দিই, তাহলে একেকজন প্রশিক্ষক তাঁর জ্ঞান বাড়াতে পারেন এবং অনেক চালককে প্রশিক্ষিত করতে পারেন।
মিথিলা ফারজানা: আইয়ুবুর রহমান খান, তাঁদের মাধ্যমে সেটি সম্ভব কি না?
আইয়ুবুর রহমান খান: যদি কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ প্রশিক্ষক থাকেন, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানটির আমরা নিবন্ধন প্রদান করি। আমরা যে ২০ জন প্রশিক্ষক ইতিমধ্যে তৈরি করেছি, তাঁদের দিয়ে ২০টি ট্রেনিং স্কুল পরিচালনা করতে এবং তাঁদের নিবন্ধন দিতে পারব। আগামী মাসে আরও যে ২০ জন বের হবে, তাঁদের দিয়ে আরও ২০টি ড্রাইভিং স্কুলে প্রশিক্ষণ দিতে পারি। যদি আরও ৪০টি ড্রাইভিং স্কুল বাড়ে, তাহলে আমাদের দক্ষ চালক তৈরির সক্ষমতা বেড়ে যাবে।
মিথিলা ফারজানা: কিন্তু তা সত্ত্বেও যেটি স্পষ্ট, আরও এক বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ অদক্ষ লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা লাইসেন্সবিহীন চালক রাস্তায় গাড়ি চালাবেন। এই ৫০ শতাংশ চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য, প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যে বেসরকারি প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো আছে, তাদের কেন আপনারা অন্তর্ভুক্ত করছেন না?
আইয়ুবুর রহমান খান: বেসরকারি প্রশিক্ষক বিআরটিএর নিবন্ধনভুক্ত নেই। আছেন মাত্র ৫৪ জন। এর বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যাটি হচ্ছে, যদি কাউকে প্রশিক্ষকের লাইসেন্স দিতে হয়, তাঁকে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, তাঁকে এসএসসি পাস হতে হবে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে, হেভি লাইসেন্সধারী হতে হবে।
মিথিলা ফারজানা: মাননীয় মন্ত্রী, বিষয়টিকে বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো মনে হচ্ছে কি না?
ওবাদুল কাদের: অবশ্যই বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সরকারি উদ্যোগের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সরকারের সক্ষমতা নেই এটাকে একা সামলানোর। আমাদের নেটওয়ার্কও অতটা শক্তিশালী নয়। কাজেই আমরা বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় করি এবং সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে এবং করবে। উভয় উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় করে বিষয়টি একটা সুন্দর সমাধানের দিকে অবশ্যই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। সময় লাগবে কিন্তু আশা করা যায়, পারব।
ইলিয়াস কাঞ্চন: বেসরকারি উদ্যোগে কিন্তু সম্ভব হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের গাড়ি চালানোর একটা নিজস্ব জায়গা না থাকবে, প্রশিক্ষক না থাকবে এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো গাড়ি না থাকবে। যেসব চালক গাড়ি চালাতে আসেন তাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র এবং এটার জন্য যে চার্জ বেসরকারিভাবে করা হবে, সেটা ওই চালকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ দুই মাস বা এক বছরের জন্য যে প্রশিক্ষণ নিতে হবে, সেটির জন্য একটা ইনসেনটিভ বা ভাতা দরকার। সেটি বেসরকারি কোনো সংস্থাই দেবে না বা বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ দেবে না।
ওবায়দুল কাদের: আপনার কথায় যুক্তি আছে। সে অবস্থায় সরকার ভাতা দিতে প্রস্তুত আছে।
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমার প্রস্তাব ছিল, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৫৪টি ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বর্তমান আছে। তাদের জায়গা আছে, সেখানে শুধু সিমুলেটর স্থাপন করা, গাড়ি দেওয়া ও প্রশিক্ষক দেওয়া। সরকার যদি মনে করে, একজন ভালো চালক তৈরি করার জন্য তাকে ২০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার পর ৫০০ টাকা করে ঋণ পরিশোধ করার জন্য তাকে যদি একটা সময় দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু এটা সম্ভব।
আইয়ুবুর রহমান খান: এই প্রকল্পটি ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ গ্রহণ করেছে। বছরে চারটি ব্যাচে তারা তিন মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেবে। ৬১টি জেলা পরিষদের মাধ্যমে এবং এর খরচটি স্থানীয় সরকার বিভাগ নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করবে। এটির দুটি দিক আছে। একটি আমাদের সড়ক নিরাপদ হবে এবং অপরটি হচ্ছে, বিদেশে হাজার হাজার দক্ষ গাড়িচালকের চাহিদা রয়েছে, আমরা বিদেশেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছি। ব্যক্তিমালিকানাধীন পার্টনারশিপ যেমন টাটা গ্রুপ, নিটল-নিলয় গ্রুপ ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কিশোরগঞ্জে একটি ড্রাইভার ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। প্রতি বছর ওখান থেকে প্রায় ৫০ হাজার গাড়িচালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
মিথিলা ফারজানা: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি যখন এই চালকদের নিয়োগ দেয়, তখন তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কি না, সেটি কি নিশ্চিত হয়? এ বিষয়ে বলবেন মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ: অনেক ক্ষেত্রে যাঁরা সচেতন মালিক, তাঁদের অনেকেই এই ব্যাপারটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। আমরা বিআরটিএর মাধ্যমে এগুলো পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে নিশ্চিত করে থাকি, আর অনেক সময় আমরা নিজেরা দেখলেও বলতে পারি, এগুলো আসলে সঠিক কি না। তার পরও আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যাপারে ইতিমধ্যে বিআরটিএর সঙ্গে আলোচনা করেছি। দেশব্যাপী শ্রমিকদের যে সংগঠনগুলো রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে একাধিকবার আমাদের আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে মালিকদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমরা প্রচেষ্টা গ্রহণ করব।
মিথিলা ফারজানা: ব্লগ লেখক রনি সরকার এ বিষয়ে আপনার কী প্রশ্ন আছে?
রনি সরকার: আপনারা ড্রাইভারদের কিসের ভিত্তিতে নিয়োগ দেন? বেশি বেশি ট্রিপ দেওয়াকে কি আপনারা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ মনে করেন না?
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ: এগুলো হয়তো বা কম দূরত্বের রাস্তাগুলোতে সম্ভব। তবে দূরপাল্লার গাড়িগুলোর বেশি ট্রিপ চালানোর সুযোগ নেই। সেখানে একটা গাড়ি যদি খুব তাড়াতাড়ি যায়, সেখানে সে হয়তো বা ৩০ মিনিট বা এক ঘণ্টা সময় বাঁচাতে পারবে।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের দুর্ঘটনা যে দিন ঘটেছিল, সেদিন চুয়াডাঙ্গা থেকে ড্রাইভার যে গাড়িটি নিয়ে সকাল সাতটায় গাবতলী টার্মিনালে এসেছিলেন, তিনিই আবার গাড়িটি নিয়ে বেরিয়েছেন সকাল নয়টায়।
মিথিলা ফারজানা: ডক্টর সামছুুল হক এই ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং কেন হয়?
ডক্টর সামছুুল হক: আমি ৫০০ জন চালকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, যানজট তাঁদের জন্য একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। যানজটে যে সময় নষ্ট হয়, তার ফাঁক পূরণ করতে গিয়ে তাঁরা এই ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং করেন এবং বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান। পাশাপাশি, গাড়ি চুক্তিতে দেওয়া হয় বলে চালক অতিরিক্ত যাত্রী ওঠান এবং পাল্টাপাল্টি আচরণের মাধ্যমে দুর্ঘটনা ঘটে।
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ: চুক্তির ভিত্তিতে গাড়ি চালানো ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটিতে কিছু কিছু হয়ে থাকে। কিন্তু দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা খুবই কম। এ বছরের মধ্যেই আমরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেব। আমরা সমিতির মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও কিছু পদক্ষেপ নেব।
মিথিলা ফারজানা: এ বিষয়ে মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট ১৯৮৩ নামে একটি নীতি রয়েছে, কিন্তু এখনো যেহেতু এটি আইন হিসেবে পাস হয়নি, তাই এ ধরনের কোনো চুক্তি দণ্ডনীয় অপরাধ নয়। এটিকে আইনে পরিণত করা যায় কি না?
ওবায়দুল কাদের: এই আইনটির পরিবর্তন প্রয়োজন। যত শিগগির সম্ভব এই আইন সংশোধন করার ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নেব। আইনটি যাতে পাস হয়, সে ব্যবস্থা নেব।
মিথিলা ফারজানা: বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৯টি দুর্ঘটনাপ্রবণ কিছু এলাকা রয়েছে, যাকে ব্ল্যাকস্পট বলে। এগুলো আসলে কী?
ডক্টর সামছুুল হক: দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান নির্দিষ্টকরণের জন্য যে সংজ্ঞাটি আছে তা হলো, একই জায়গায় তিন বছরে যদি তিনটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে অথবা পাঁচটা সাকসেসিভ বছরে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সাধারণত ওই স্থানকে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান বা ব্ল্যাক স্পট বলে।
মিথিলা ফারজানা: আপনারা এই জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করা বা চালকদের সচেতন করার জন্য কোনো ধরনের সংকেত দিয়েছেন কি?
আমিনুর রহমান লস্কর: ঢাকা-আরিচা সড়কে অনেকগুলো ব্ল্যাকস্পট আছে। এরই মধ্যে তিনটি ব্ল্যাকস্পট সরিয়ে দিয়ে রাস্তা প্রশস্ত করা হয়েছে।
মিথিলা ফারজানা: এখানে যখন চালকেরা গাড়ি নিয়ে যান, তখন কি তাঁরা জানেন এটি একটি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা? এখানে তাঁদের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
আমিনুর রহমান লস্কর: সাবধানতা অবলম্বনের জন্য অধিকাংশ ব্ল্যাকস্পটেই সংকেত নেই। কিছু কিছু আছে। যত ব্ল্যাকস্পট আছে, ক্রমান্বয়ে এগুলোর সব কটিই আমরা সোজা করব।
মিথিলা ফারজানা: সেটির জন্য আপনারা কত দিনের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন?
ওবায়দুল কাদের: ২০৯টিতে আমরা একযোগে শুরু করতে পারব না। প্রাথমিকভাবে আমরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ২২টি ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করেছি। শুধু চিহ্নিত করলেই হবে না, বাঁকগুলো যতটুকু পারা যায় সোজা ও প্রশস্ত করতে হবে এবং রাস্তাকে পর্যায়ক্রমে চার লেনে উন্নীত করা হবে। এ কারণে আমরা মাঝখানে আইল্যান্ড (সড়কদ্বীপ) দিতে পারছি না। আমরা আপাতত এম এস ফাইভ ডিভাইডার স্থাপন করেছি। তিনটি বাঁকে এ রকম ব্যবস্থা এরই মধ্যে করা হয়েছে। আমি তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি। এ সময়ের মধ্যেই রাস্তা প্রশস্তকরণ এবং ডিভাইডার স্থাপনের কাজ সবগুলো স্পটে সম্পন্ন করতে হবে।
ডক্টর সামছুুল হক: আমাদের দেশে বাণিজ্যিক গাড়ি হচ্ছে বাস ও ট্রাক। প্রস্তুতকারকেরা বাসগুলোতে যেভাবে সিটসংখ্যা বলেন, মালিকেরা তার থেকে কিন্তু আরও বেশি করে ফেলেন। এতে ভেতরে যে নিরাপদ সিট হওয়ার কথা, সেটা হয় না। এগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটার পর পরিণতি অনেক মারাত্মক হয়। বাসের ওপর কোনো রেলিং লাগানো মূল প্রস্তুতকারকেরা অনুমোদন করেন না। ওপরে অতিরিক্ত ওজন নিলেই বাস কিছুটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। পাশাপাশি ট্রাকের ক্ষেত্রেও লোড বেশি করার জন্য লম্বা ও চওড়া করা হচ্ছে এবং উচ্চতাও বাড়ানো হচ্ছে। ওভারলোডিং কিন্তু চালক, গাড়ি ও রাস্তার জন্য খারাপ এবং ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে বেশি মারাত্মক হচ্ছে ট্রাকের দুই পাশে তিনটি তিনটি করে যে অ্যাঙ্গেল লাগানো হয়েছে এটা একটা মারণাস্ত্রের মতো। বাসের সবচেয়ে দুর্বল অংশ জানালায় আঘাত করে মানুষসহ সবকিছু ছিঁড়ে ফেড়ে নিয়ে যায়।
মিথিলা ফারজানা: আইয়ুবুর রহমান খান, কী করে এই যানবাহনগুলো ফিটনেস সার্টিফিকেট পায়?
আইয়ুবুর রহমান খান: সারা দেশে যারা গাড়ির বডি তৈরি করে, তাদের কোনো ওয়ার্কশপ বিআরটিএর নিবন্ধনভুক্ত নয়। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি বিধি করে সব ওয়ার্কশপ এবং বডি বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠানকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য। আওতায় চলে এলে তখন বডি নিয়ম অনুযায়ী না বানালে আমরা তাদের ধরতে পারব। তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা যাবে। দ্বিতীয়ত, অনেক সময় ৩১ সিটের গাড়ি ৩১ সিট করেই রেজিস্ট্রেশনের জন্য আমাদের কাছে নিয়ে আসে এবং রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন করানোর পর আসনসংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। তারা কোনো না কোনোক্রমে পার পেয়ে যাচ্ছে।
ওবায়দুল কাদের: আমাদের এখন যে ফিটনেস পরীক্ষা, সেটা কিন্তু ক্রমান্বয়ে করা হয়। এটা খুব বিপজ্জনক। এখন ফিটনেস না থাকলেও বলে ফিট। ফিটনেস থাকে এ রকম গাড়ি খুব কম, শুধু নতুন গাড়িগুলো ছাড়া। মিরপুর বিআরটিএতে গিয়ে দেখলাম, বিরাট বন্ধ ঘরে একটা যন্ত্র পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কী? বলা হলো, ভেহিকেল ইনস্পেকশন সেন্টার। এটা ১৬ বছর ধরে পড়ে আছে। ব্যবহার হচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলাম, কারণ কী? জানাল, এখানে দেশি এবং বিদেশি সমন্বয়ের কনসালট্যান্ট দরকার। দেশি পরামর্শক পাওয়া যায় কিন্তু বিদেশি পরামর্শক পাওয়া যাচ্ছে না। সারা বাংলাদেশে এ রকম পাঁচটি সেন্টার বন্ধ রয়েছে।
মিথিলা ফারজানা: ব্লগ লেখক মাসুদ খান এ বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন আছে?
মাসুদ খান: আউটসোর্সিং করে যোগ্য যানবাহনগুলোর ফিটনেস দেওয়ার নিশ্চয়তাটি আপনারা করে দিতে পারেন তো?
আইয়ুবুর রহমান খান: আমরা তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ফিটনেস আউটসোর্সিংয়ে চলে যাব। আমরা আশা করি, দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে সব ফিট গাড়ি আমরা রাস্তায় দেখতে পাব। এখানে মালিকদেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ: এখানে সিট বাড়িয়ে গাড়ির অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের যে প্রবণতা, এটা বিআরটিএ ইচ্ছা করলে রোধ করতে পারে। আমরা এ ব্যাপারে বিআরটিএকে সহযোগিতা করতে চাই। যারা এগুলো করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে যে চাকা আমদানি করছে, এটাও কিন্তু বিআরটিএর তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসতে হবে। কন্ট্রোলে না নিলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না।
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ: টায়ারে লেখা থাকছে ১৮ বা ২০ প্লাই (নাইলন স্তর), কিন্তু টায়ার পানচার হওয়ার পর দেখেছি ৯ বা ১০ প্লাই। এর ফলে গাড়ির সামনের চাকা যদি পানচার হয়, সেটা দুর্ঘটনায় পতিত হবেই। বাসের টায়ারের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা বিএসটিআইকে পত্র দিয়েছি এবং আশা করি এটা অতি দ্রুত হয়ে যাবে।
আইয়ুবুর রহমান খান: বিএসটিআইয়ের সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয় বৈঠক করে সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে টায়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য যে প্রযুক্তি দরকার, এটা এ মুহূর্তে তাদের কাছে নেই। তবে তারা চেষ্টা করছে। কয়েক মাসের মধ্যে প্রযুক্তি এনে তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।
মিথিলা ফারজানা: সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অহত লোকজনের চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে আসল চিত্রটি কেমন?
ডা. ফজলুর রহমান: আমাদের দেশে যত লোক মারা যায়, তার ৫০ ভাগ মারা যায় দুর্ঘটনা ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যে। বাকি ১৫ ভাগ মারা যায় চার ঘণ্টার মধ্যে এবং ৩৫ ভাগ মারা যায় হাসপাতালে। ৫০ ভাগ মারা যাচ্ছে পুরোপুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাপনার অভাবে। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা বা ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে পারলে এদের হয়তো বাঁচানো সম্ভব। দরকার কিছু ফার্স্ট রেসপন্ডার তৈরি করা। অর্থাৎ দুর্ঘটনা যে জায়গায় ঘটবে, সে জায়গায় যদি চিকিৎসা দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে পারা যায়, তাহলে হয়তো অনেক লোককে বাঁচাতে পারব। প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মী তৈরি করতে পেট্রল পাম্প, সিএনজি স্টেশন বা স্থানীয় ওষুধের দোকানগুলোতে যারা কাজ করে, তাদের প্রশিক্ষিত করে ফার্স্ট রেসপন্ডার করতে পারি। অথবা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী ও শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে পারি।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: মহীপালের ট্রমা সেন্টারটি তৈরি হয়েছে ২০০২ সালে, তা এখনো উদ্বোধন হয়নি। আমরা দুপুর আড়াইটায় গিয়েছি, ট্রমা সেন্টারে তখন অন্ধকার। বিদ্যুৎ ছিল না। সেখানে পেয়েছি একজন সহকারী চিকিৎসককে। তিনি বলছেন এখানে জ্বরের চিকিৎসা হয় এবং আশপাশের লোকালয়ে ট্রমা সেন্টারটি পরিচিত না এবং তারা জানতেই পারছে না যে, এটা একটা হাসপাতাল।
ডা. ফজলুর রহমান: এর সঙ্গে অন্যান্য হাসপাতালে বিশেষত জরুরি সেবার ব্যবস্থা গুরুত্ব দিয়ে রাখা দরকার। আমাদের দেশে জরুরি সেবা সেভাবে চালু নেই।
ওবায়দুল কাদের: যদিও এটা আমাদের মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়, তবুও আমি মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে অনুরোধ করব, যেন ট্রমা সেন্টারটি অতি দ্রুত উদ্বোধনের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ডা. ফজলুর রহমান: আমরা নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সব বিষয় দেখাশোনার জন্য আলাদা একটা সড়ক নিরাপত্তা বিভাগ তৈরির কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কি না? বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।
ডক্টর সামছুুল হক: এর সঙ্গে একটা জরুরি উদ্ধারকারী দলও থাকা দরকার। দুর্ঘটনা ঘটার পর কাকে জানাতে হবে, এটা অনেকেরই জানা নেই। জানাতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া যাবে, তার তত বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। পুরো পৃথিবীতে প্রতিটি দেশে একটা ইউনিক নাম্বার থাকে, যেটা মানুষ সব সময় মনে রাখে। যেমন: ৯১১। এখন মুঠোফোন কোম্পানিগুলো এই দায়িত্ব নিতে পারে। মুঠেফোন থেকে যখনই ফোন করা হবে, মনে হয় লোকেশন বলার দরকার নেই। কারণ, অপারেটররা জানেন এই লোকেশনটা কোথায় এবং তাদের কাছে ডেটাবেইস থাকবে নিকটস্থ হাসপাতাল কোনটা, ফায়ার ব্রিগেড কোনটা, পুলিশ স্টেশন কোনটা। তাই তারাই ক্রমান্বয়ে জানিয়ে দেবে।
মিথিলা ফারজানা: মাননীয় মন্ত্রী, হাইওয়ে পুলিশের যে একটা অস্তিত্ব ও গুরুত্ব সেটা আমাদের দেশে দেখি না।
ওবায়দুল কাদের: হাইওয়ে পুলিশ সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করে উঠতে পারে না। তাদের ক্ষমতাও একটু কম। পুলিশের জনবল ও যন্ত্রপাতি কম আছে। এসব জরুরি বিষয়ে আমরা যাতে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি, সে উদ্যোগ অবশ্যই নেব।
মিথিলা ফারজানা: আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমরা তাকিয়ে থাকব আপনারা যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছেন সেগুলোর দিকে এবং যে সময় দিয়েছেন সেই সময়ের মধ্যে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সুফল আমরা কতটা পাই, তার দিকে। আমরা এরপর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেব প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে বা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.