স্মরণ-আসফউদ্দৌলা রেজার ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী by নাজনীন মহল অঞ্জনা

স্নেহময় বাবা তোমাকে হারালাম সেদিন যেদিন ফুলের সমারোহে এসেছিল বসন্তরাজ। ১৩৮৯ সনের পহেলা ফাল্গুনের প্রথম প্রহর। চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছ তুমি প্রাণচাঞ্চল্য ভরা কর্মপাগল মানুষ সেই চিরচেনা হাসি ছড়ানো মুখ। সাদা কাপড়ে জড়ানো নিথর শীতল দেহ, বসন্তের ফুলে ফুলে ভরে গেছে পারিবারিক গোরস্থানটি।


মন ছুঁয়ে যায়। কে বলে বাবা তুমি নাই/তুমি আছ মন বলে তাই। তোমাকে হারানোর যন্ত্রণা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞার অবর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাকের হাল ধরেছিলে তুমি (বার্তা সম্পাদক হয়ে। আর ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন (কার্যনির্বাহী সম্পাদক)। তোমাদের ক্ষুরধার কলম ইত্তেফাককে করে তুলেছিল জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের মুখপত্র। তাই একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইত্তেফাকের ওপর। যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ব্যস্ত আর তোমরা কজন তখনো আগামীকালের পত্রিকা জনগণের দুয়ারে পেঁৗছানোর শেষ চেষ্টায় রত। কামানের গোলায় দেয়াল ধসে পড়লে পেছনের জানালা দিয়ে দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে জীবনে বেঁচে এসেছিলে। স্ত্রী-সন্তানের মাঝে। আতঙ্কিত ৯টি মাস পরিবার নিয়ে কাটিয়েছ ঢাকা শহরের বুকে। তোমার গতিবিধির ওপর ছিল পাকিস্তানিদের কড়া নজর। বাসায় ছদ্মবেশে আসতেন মুক্তিযোদ্ধারা। জরুরি কাগজপত্র, ক্যাসেটে খবরাদি আদান-প্রদান, খাদ্য, অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে তুমি তাঁদের।
কতবার সেনাবাহিনীর গাড়ি এসে তোমাকে তুলে নিয়ে গেছে, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছ কতবার! আমরা ভীষণ ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতাম। মা আমাদের সাহসভরে আগলে রাখতেন। দালাল বাঙালি ও উর্দুভাষী কিছু তরুণ বালক বাসায় হামলা করে। করুণাময়ের কৃপায় রক্ষা পেয়েছিলে তুমি। কতজন জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল তোমার কাছে। ত্রিশ লাখ প্রাণ বিসর্জনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে সহপাঠী, প্রাণপ্রিয় বন্ধু সহকর্মী সিরাজুদ্দীন হোসেনকে হারিয়ে ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলে তুমি। নিজের জীবনের ঝুঁকি জেনেও হন্যে হয়ে ছুটেছ বন্ধুর খোঁজে। তুমি বলতে ইত্তেফাক আমার আরেক সন্তান। তোমার মৃত্যুতে বেগম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা বলেছিলেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা ইত্তেফাক ভবনের প্রতিটি ইটের ভাঁজে রেজা সাহেবের ঘাম মিশে আছে। শুধু ইত্তেফাক নয়, আমার পরিবারে যেকোনো সমস্যায় আমি তাঁকে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি। তাঁর অবর্তমানে আমার সন্তানরা এসব গুরুদায়িত্ব সামলাবে কিভাবে? 'ইত্তেফাকের স্থপতি, সাংবাদিকতা জগতের নক্ষত্রপুরুষ, আপসহীন হেড মাস্টার' 'মানুষের মতো মানুষ, খাঁটি মানুষের প্রতিকৃতি, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক, পরোপকারী ইত্যাদি বিশেষণে বিভূষিত হয়েছ তুমি মৃত্যুর পর।
বাবা, তুমি জন্মেছিলে এমন এক পরিবারে, যে পরিবারটি ছিল অর্থ-বিত্ত ও শিক্ষাজ্ঞানে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। মহারানি ভিক্টোরিয়া যাঁকে দানবীর সম্মানে ভূষিত করেছিলেন সেই মানিক উদ্দীন সরকারের পুত্র তোমার পিতা দানশীল জমিদার আজগর হোসেন ছিলেন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। তোমার স্নেহময়ী মা সৈয়দা ফেরদৌস মহল সিরাজী ঢাকা ইডেনের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী। নারীশিক্ষা আন্দোলনকারী। নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ তাঁকে সোনার দোয়াত-কলম উপহার দিয়ে উৎসাহী করেছিলেন, ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে জাতির চেতনায় 'অনল প্রবাহ' সঞ্চারিত করেছিলেন তোমার নানা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
নাজনীন মহল অঞ্জনা

No comments

Powered by Blogger.