আম ॥ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি সম্ভাবনা

পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু ফল হচ্ছে আম। আর এই আম চাষের জন্য বাংলাদেশের জলবায়ু খুবই উপযোগী। দেশের সর্বত্র আম উৎপন্ন হলেও দেশের বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয়। উন্নতজাতের আম বেশি পাওয়া যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে।


বিশ্বে আম উৎ্পাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২ তম। কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে বার্ষিক উৎপাদিত আমের পরিমাণ ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন। গবেষণায় দেখা যায়, দেশে উৎপাদিত আমের চাহিদা মেটানোর পরও ৭০ শতাংশ উদ্বৃত্ত আম বিদেশে রফতানি করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হচ্ছে না কিছু সমস্যার কারনে। যেগুলোর সমাধান করা গেলে দেশে উৎপাদিত আম বিদেশে রফতানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
আম উৎপাদনের আশানুরূপ ফলন বাড়াতে হলে রাজশাহী অঞ্চলের পাশাপাশি অন্যান্য অঞ্চলগুলোকেও আম উৎপাদনের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায়, হার্টেস্ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মাত্র ৩ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন আম রফতানি করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ একই সময়ে প্রতিবছর ভারত প্রায় ৪১ হাজার মেট্রিক টন অন্যদিকে পাকিস্তান প্রায় ৪৭ হাজার মেট্রিক টন আম রফতানি করে থাকে। রফতানির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২০০৮ সালে সর্বপ্রথম জাপান বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের আমের নমুনা পর্যবেক্ষণ করে তারা ইতিবাচক সাড়া দিলেও পরবর্তীতে তাদের এই আগ্রহে ভাটা পড়ে। এর পর ২০১০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বারি-২ জাতের আমের নমুনা পাঠানো হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও প্রথমে ব্যাপক সাড়া পেলেও পরবর্তীতে ঐ সম্ভাবনা আলোর মুখ দেখেনি। দেশে বর্তমানে গোপালভোগ, ল্যাংড়া, মোহনভোগ, সূর্যপরি, ফজলি, বোম্বাই, ক্ষীরসা, মিছিরিকান্ত, দুধসর, লকনা, বারি-২, বারি-৭, হিমসাগর, আম্রপালি প্রভৃতি জাতের আম চাষ হয়ে থাকে।
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব আম রফতানি করে খুব সহজেই ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ডের মতো আম রফতানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে বাংলাদেশ। আম রফতানির প্রচেষ্টায় গঠিত সংগঠন বাংলাদেশ ম্যাংগো প্রডিউসার মার্চেন্টস এ্যাসোসিয়েশন আম রফতানির বিষয়টি মাথায় রেখে আমচাষী ও সংশ্লিষ্টদের সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সচেতন করার চেষ্টা করছে।আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা, উন্নত প্যাকিং ও বিপণন ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে বৈদেশিক রফতানির কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
দেখা যায়, শুধু আম রফতানিই নয় আমকেন্দ্রিক অন্যান্য শিল্প কারখানাও দেশে তেমন গড়ে ওঠেনি। এখানে আম প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা রয়েছে। তাই মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই লোভনীয় ফলটির স্বাদ থেকে আমাদের বঞ্চিত হতে হয়। আম গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, শুধু প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবেই দেশে উৎপাদিত মোট আমের ২৭ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে উৎপাদিত মোট আমের .৫ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করা হয়। যেখানে ভারতে এ হার ২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে ৭০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৮৩ শতাংশ, থাইল্যান্ড ও ফিলিপিন্সে এই হার ৭৩ শতাংশ। রফতানির পাশাপাশি সারাবছর এই উপাদেয় ও পুষ্টিকর ফল সংরক্ষণ করার মাধ্যমে যাতে দেশের চাহিদা মেটানো যায় তার জন্য সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিত।
আমাদের দেশের আম চাষীদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, আম নিয়ে গবেষণা বৃদ্ধি, সংরক্ষণের ব্যবস্থা, রফতানির জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ, আমে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার সীমিতকরণ, রফতানিযোগ্য আম চাষ সম্প্রসারণ, চাপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী-নাটোর অঞ্চলকে রফতানি জোন হিসেবে ঘোষণাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আধুনিক পদ্ধতিতে আম চাষ না করা ও উন্নত বিপণন ব্যবস্থার অভাবেই আম রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় বিশ্বে আম উৎপাদনের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। বর্তমানে এই অবস্থান হচ্ছে দ্বাদশ। ১৯৮৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেশের একমাত্র আম গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। কিন্তু দেখা যায় ঐ কেন্দ্র থেকে সঙ্কর জাতের নতুন কিছু আম ছাড়া এখন পর্যন্ত কোন ভাল জাতের আমের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি। এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে সাধারণত যে আমের জাতগুলো উদ্ভাবন করা হয়েছে তা হচ্ছে আম্রপালি, সাটিয়ারক্যাড়া, মহানন্দা। বর্তমান সরকার আম গাছকে জাতীয় গাছ হিসেবে নির্বাচিত করেছে। কাক্সিক্ষত সফলতা পেতে হলে আম চাষের বিভিন্ন প্রতিকূলতা যেমন; রোগবালাই, ওষুধ, পরিচর্যা পদ্ধতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতির সমাধানের মাধ্যমে আম চাষীদের উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন।
আমাদের দেশে এখনও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে আম চাষ করা হয় না। শুধু সুষ্ঠু পরিকল্পনার বাস্তবয়ানের মাধ্যমেই আমকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব তেমনি আমকেন্দ্রিক বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে নতুন অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও সম্ভব।
সুমন রহমান

No comments

Powered by Blogger.