হাওয়া ভবনে-গ্রেনেড হামলার আলামত নষ্টে বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং

০ জজ মিয়ার মতো ৩ পুলিশ কর্মকর্তাকেও লোভ দেখিয়ে বাগে আনা হয় ০ গোপন বৈঠকে কৌশল নির্ধারণত
গাফফার খান চৌধুরী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদনত্ম ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়ার পরিবারকে যেমন আজীবন ভরণপোষণের লোভ দেখানো হয়েছিল, তেমনি সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তাকেও আজীবন


বিএনপি-জামায়াতের তরফ থেকে সুবিধা দেয়ার লোভ দেখানো হয়েছিল। এ আইডিয়াটিও এসেছিল হাওয়া ভবন থেকে। হাওয়া ভবন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসংক্রানত্ম যাবতীয় বিষয়েই জড়িত ছিল। ইতোমধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপি-জামায়াত জোটের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিৰা উপমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকত-উল-জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ অনেককে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিআইডি সূত্র জানায়, হাওয়া ভবনই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার কালের সাৰী। হামলা থেকে শুরম্ন করে সব ছিল এ বিশেষ ভবনের নখদর্পণে। সর্বশেষ অপারেশন সাকসেসফুল না হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ঘটনার দায় এড়ানোর দায়িত্বও পড়ে হাওয়া ভবনের ওপর। সরকারের তরফ থেকেই আনঅফিসিয়ালি হাওয়া ভবনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। দায় এড়াতে করণীয় সম্পর্কে হাওয়া ভবনে বৈঠক হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের সুবিধা দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এরপর শুরম্ন হয় হাওয়া ভবনের বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং। তারই ধারাবাহিকতায় গ্রেনেড হামলা মামলা দ্রম্নত চলে যায় সিআইডিতে। প্রথমে আলামত গায়েব করার সিদ্ধানত্ম হয়। আলামত গায়েব করার পেছনেও ছিল বিরাট রহস্য। গোয়েন্দাদের ধারণা, হাওয়া ভবন পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগে থেকেই জেনে থাকায় আলামত গায়েবসহ তদনত্ম ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এ বিশেষ ভবনটির কোন অসুবিধা হয়নি। এমনকি তদনত্ম ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কেও বিসত্মারিত আলোচনা হয় বাতাস ভবনের গোপন বৈঠকে।
তদনত্মকারী কর্মকর্তাদের বাগে আনতে বিশেষ কৌশল নেয়ার সিদ্ধানত্ম নেয় হাওয়া ভবন। প্রথম দিকে বেশকিছু উদ্যোগ ভেসত্মে যায়। পরবতর্ীতে সিআইডির সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তাদের বিএনপি-জামায়াত আজীবন নানা ধরনের সুবিধা দেবে, এমনকি এ প্রতিশ্রম্নতির বিষয়টি হাওয়া ভবনের কর্ণধার নিজেই নিশ্চিত করবেন। সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তাদের যাবতীয় বিষয় দেখভাল করা হবে। হাওয়া ভবনের কর্ণধারের মাথায় এমন চমৎকার উদ্ভাবনীতে সবাই অবাক। আইডিয়া বাসত্মবায়নের দায়িত্ব পড়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ওপর। বাবর আগ্রহের সঙ্গে এটি বাসত্মবায়ন করতে মাঠে নেমে পড়েন। প্রথমে হাওয়া ভবন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা দু'টি বেমালুম গায়েব করে দিতেও চেষ্টা করেছিল। পরে তা সম্ভব হয়নি। কৌশল পাল্টে এ বিশেষ ভবনটির পরামর্শ মোতাবেক মামলার আলামত নষ্ট করার সিদ্ধানত্ম হয়।
এদিকে সংশিস্নষ্ট সিআইডি কর্মকর্তাদের পরিবারের আজীবন সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা ও পদোন্নতির আশায় বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সিআইডির সাবেক এসপি রম্নহুল আমিন, এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশীদ। রাতের অাঁধারে সিআইডি সদর দফতরে আলামত গায়েব প্রক্রিয়া শুরম্ন হয়। বিশেষ করে পরবতর্ীতে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত গ্রেনেডের কোন অংশেরই অসত্মিত্ব পাওয়া যায়নি। আলামত সম্পর্কে সরকারের সংশিস্নষ্ট তরফ থেকে বলা হয়েছিল, জব্দকৃত আলামত সম্পূর্ণ হেফাজতে রয়েছে। তবে উদ্ধারকৃত গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। এসব গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় না করা পর্যনত্ম নিরাপদ নয়। যে কোন সময় বিস্ফোরণ ঘটে জানমালের ৰতি হতে পারে। জনস্বার্থে গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।
সরকারের তরফ থেকে প্রচার করা হয়, আওয়ামী লীগের অভ্যনত্মরীণ কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগের একটি বিদ্রোহী গ্রম্নপ শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকমর্ীসহ রাতারাতি ২০ জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি পুলিশ। মামলার তদনত্ম ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নোয়াখালী জেলার সেনবাগ এলাকার দরিদ্র পরিবারের সনত্মান জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে গুলশান থানার একটি হত্যা মামলার আসামি দুই ভায়রা আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জের ফতুলস্নায় অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে এ দু'জনকেও গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরবতর্ীতে জজ মিয়ার দরিদ্র পরিবারকে আজীবন ভরণপোষণ দেয়ার লোভ দেখিয়ে, নতুবা মিথ্যা খুনের মামলায় সারাজীবন জেল খাটানোর ভয় দেখিয়ে এবং শফিকুল ইসলাম ও আবুল হাশেম রানাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করে সিআইডি কর্মকর্তারা।
পরে আদালতে জজ মিয়া, আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলামের ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীর জোরেই সিআইডি পুলিশ বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে মামলার চার্জশীট দাখিলের অনুমতি চায়। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মামলার পুনর্তদনত্ম শুরম্ন হয়। সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল কবীর তদনত্মের দায়িত্ব পান। তদনত্মে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহের বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যায়। ২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। বাকিরা পলাতক।
পরে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদনত্ম ভিন্ন খাতে প্রবাহের অভিযোগে মামলার চার্জশীট দাখিলকারী কর্মকর্তা বাদী হয়ে রাজধানীর পল্টন থানায় ২০০৮ সালের ৩০ মার্চ সিআইডির সাবেক ওই ৩ কর্মকর্তার বিরম্নদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আসামিদের বিরম্নদ্ধে মামলার আলামত নষ্ট ও জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়ের অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি সিআইডির এএসপি রওনকুল হক চৌধুরী তদনত্ম করছেন। তদনত্মকারী কর্মকর্তা রওনকুল হক চৌধুরী গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ২০০৮ সালের ৭ এপ্রিল জজ মিয়ার সাৰ্য নেন। পরে জজ মিয়ার মা জোবেদা বেগম, বোন খুরশীদা বেগম, ভাই আবুল হোসেন, মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে পরবতর্ীতে কারামুক্ত হওয়া শৈবাল সাহা পার্থ, ঢাকার ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মোখলেছুর রহমান, আদালতে ১৬৪ ধারায় মিথ্যা জবানবন্দী দেয়া আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলামের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। পরে আদালতে জজ মিয়া, আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলামের ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দী গ্রহণকারী দুই বিচারক শফিক আনোয়ার ও জাহাঙ্গীর আলমের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। পরবতর্ীতে সিআইডির অভিযুক্ত ৩ কর্মকর্তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। পরে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে ২১ আগস্ট মামলায় দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে বাবর গ্রেনেড হামলা মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহের সঙ্গে হাওয়া ভবনের কর্ণধাররা জড়িত বলে সিআইডিকে জানায়। এমনকি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়ে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যা হয়েছে তার নেপথ্য কারিগর ছিল এ বিশেষ ভবন। পরবতর্ীতে জজ মিয়া, আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলাম সিআইডির অভিযুক্ত ৩ কর্মকর্তার পুরো কাহিনী সিআইডির কাছে বর্ণনা করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.