কলকাতা বইমেলা বনাম বাংলাদেশের 'দাজ্জাল' by মহসীন হাবীব

এবার কলকাতা বইমেলায় ছুটে গিয়েছিলাম। আরেকটি বাংলা ভাষাভাষী জনপদের বইমেলায় গিয়ে হাজির হওয়ার প্রধানতম আগ্রহ এবং উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের একুশে বইমেলার সঙ্গে কতটা পার্থক্য রয়েছে ওপারের মেলার, তা নিজ নয়নে পরখ করা। দ্বিতীয় কারণটি ছিল, 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া'।


তাই পশ্চিমবাংলার রাজধানী কলকাতার গ্রন্থমেলা চোখ খুলে দেখেছি, মন দিয়ে অনুভব করেছি। এ মেলা কলকাতার একপ্রান্তে (বলা যায়) সায়েন্স সিটি নামে গড়ে ওঠা মিলনমেলায় ২৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হলো। গত কয়েক বছর ধরে এখানেই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। আগে কলকাতার মেলা হতো শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ময়দান বা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর কলকাতা কর্তৃপক্ষের ৪০০ হেক্টর বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ থেকে আদালতের নির্দেশে মেলা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ওই সায়েন্স সিটিতে (ময়দানকে সবুজ রাখতে কলকাতার কর্তৃপক্ষ এখন বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন সিপিএমকে সেখানে একটি সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এ শর্তে যে, সেখানে কোনো খুঁটি পোঁতা যাবে না, মাঠে বা আশপাশে কোনো রান্না করা যাবে না, কোনো খোঁড়াখুঁড়ি চলবে না)। এ স্থান পরিবর্তনে সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ নিয়ে আহামরি কোনো বিতর্ক নেই, ওঠেনি। আক্ষেপ করে কেউ হয়তো বলল, মেলাটা আগে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে ছিল_ভালই হতো ওখানে থাকলে। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলে ওঠে, না না, মেলা সরিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধির কাজ হয়েছে। তবে এ খুনসুঁটি বইমেলার প্রাণকে স্পর্শ করতে পারেনি। ময়দানে থাকতে কলকাতা বইমেলার প্রবেশমূল্য ছিল তিন-চার রুপি। মেলার ভেন্যু পরিবর্তন হওয়ার পর সে প্রবেশমূল্য তুলে দেওয়া হয়েছে। কলকাতাবাসী কেউ কেউ জানালেন, সম্ভবত ওই টিকিট রাখার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অবাঞ্ছিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ভিড় এড়ানো। যেহেতু এখন সায়েন্স সিটির মিলনমেলায় একটু ঝক্কিঝামেলা করে আসতে হয়, তাই অবাঞ্ছিত মানুষের প্রবেশের সম্ভাবনাও কমে গেছে। আর সে কারণেই টিকিটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কথাটি সঠিক হয়ে থাকলে বলতে হবে, মেলার আয়োজকদের স্বচ্ছ দৃষ্টি রয়েছে বটে।
এটুকু ছাড়া কলকাতা বইমেলা এবং ঢাকার বই মেলার বর্তমান বাহ্যিক চেহারায় বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। একই রকম অস্থায়ী নির্মিত স্টলগুলো দাঁড়িয়ে আছে, একই রকম বই সাজিয়ে রাখা হয়েছে, প্রায় একই রকম গেট তৈরি হয়েছে এবং একই অঙ্গভঙ্গিতে পুলিশ ডিউটি করে চলেছে। কিন্তু অন্তর্নিহিতভাবে, মূল্যবোধে ও চেতনায় এক বড় পার্থক্য অভাগার চোখে ধরা পড়েছে। কলকাতা গ্রন্থমেলাকে আক্ষরিক অর্থেই বইয়ের প্রদর্শনী বলে মনে হয়েছে। মেলায় বইয়ের পাঠকরা ঘুরেফিরে দেখছেন। স্টলে যে সব প্রকাশক-সেলসম্যান দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন, তাঁরাও সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলছেন, বই কিনতে হবে এমন কোনো কথা নেই, আমাদের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখুন, কী প্রকাশ হলো সেটা দেখুন। পাঠকদের মধ্যেও সত্যি অনেকে কিছু কিনছেন না, শুধু নেড়ে দেখছেন। এসব নিয়ে প্রকাশকদের কোনো অসন্তুষ্টি নেই। লক্ষ করা গেল, অনেক তরুণ-তরুণী বই না কিনে শুধু বই ও প্রকাশকের নাম টুকে নিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ জানা গেল, মেলা প্রাঙ্গণে বইক্রয়ের ওপর মাত্র ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু কলকাতার বিখ্যাত কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোতে (সে আরেকটি জগৎ) একই বইয়ে ২০ শতাংশ ছাড় দিয়ে বিক্রি করা হয়। সুতরাং অবলীলায় এ সুযোগটি নিচ্ছে পাঠক সমাজ। অর্থাৎ কলকাতার প্রকাশকরা শুধু মেলা প্রাঙ্গণে বাণিজ্য করার জন্য যে বই সাজিয়ে বসেন না, সেটা পরিষ্কার। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা একুশের বইমেলায় কি দেখি? যেন বেচাকেনার বতর এসেছে। সারা বছর অপেক্ষার পর প্রকাশকরা এ সময়েই ৮০ ভাগ বাণিজ্য সেরে নেবেন। তারপর সারা বছর আবার আগামী বইমেলার বই 'উৎপাদনে' ব্যস্ত থাকবেন।
তাই বলে কলকাতার মেলায় বই যে বিক্রি হচ্ছে না, তা নয়। অসংখ্য পাঠক তাঁদের প্রয়োজনীয় বইটি মেলা থেকেই সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। কলকাতা বইমেলার সবচেয়ে ভালো লাগার দিকটি হলো, সেখানে একচেটিয়া (মনোপলি) লেখক নেই। পাঠকের স্বাদ ও আগ্রহের মাঝে বৈচিত্র্য রয়েছে। একদিকে সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, মুস্তাফা সিরাজ থেকে শুরু করে মাঝারি ও নতুন উঠে আসা লেখকদের লেখা যেমন বিক্রি হচ্ছে, তেমন পাঠকের আগ্রহও রয়েছে সব ধরনের বিষয়ের ওপর। এমনকি লিটল ম্যাগাজিন চত্বরেও নানা বয়সের পাঠক হাতিয়ে বেড়াচ্ছেন পছন্দের বিষয়ের খোঁজে। আনন্দ ও দে'জ পাবলিশার্সে অপেক্ষাকৃত ভিড় বেশি থাকলেও অন্য প্রকাশকরা কলকাতার গ্রন্থমেলায় বসে মাছি মারছেন না। কিন্তু সেখানে একই ভাষাভাষী পাঠকদের একুশে গ্রন্থমেলার চেহারা কেমন? মাত্র হাতেগোনা দু-তিনজন লেখকের বই হুমড়ি খেয়ে মানুষ কিনে নিচ্ছেন। কী লিখেছেন সেটা বিষয় নয়, কে লিখেছেন_সেটাই মুখ্য হয়ে গেছে। এ ধারা থেকে সহসা ঢাকার পাঠক সমাজ বের হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য পাঠকদের একতরফা দোষ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। লেখকদের পাঠক টেনে নেওয়ার একটি বিষয় আছে। সে কাজটি কয় জন লেখক করতে পারছেন বাংলাদেশে? রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, মানিক, বিভূতি, মুজতবা আলী, শওকত ওসমান বা ওয়ালিউল্লাহর উত্তরসূরিরা পাঠকের সামনে কী তুলে ধরছেন? বাংলাদেশে এখন বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর_সব নামের লেখক আছেন। আছে আকর্ষণীয় মলাট-প্রচ্ছদ, আছে চটকদার বিজ্ঞাপন। কিন্তু 'বইগুলোর' ভেতরে কী? শিশুসাহিত্য বলতে প্রকাশ হচ্ছে ভূতের বই। কোনো লেখকের ভূতের নাম কালো ভূত, আবার কোনো লেখকের বইটির নাম সাদা ভূত। এই তো? ছোটবেলায় আমরা রাজকন্যা সবিতার গল্প পড়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অনূদিত শিশু সাহিত্য পড়েছি। কোথায় সে সব? ফলে পাঠক ঝুঁকে পড়েছেন এক ধরনের কাতুকুতু দিয়ে হাসানো বইয়ের দিকে। ইউরোপে লংড্রাইভে যাওয়ার পথে এক ধরনের স্টল আছে। সে দোকানগুলোতে বিয়ার, চকোলেট, শিশুদের খেলনার পাশাপাশি এক ধরনের অত্যন্ত হালকা মেজাজের, হালকা রসিকতার চটি বই পাওয়া যায় ক্লান্তিকর যাত্রাপথে পড়ে মজা কুড়ানোর জন্য। এসব ওই গাড়ি ড্রাইভ পর্যন্তই থাকে। কারো ঘরে বুকশেলফে শোভা পায় না। রাস্তার হাসির খোরাক রাস্তায় শেষ হয়ে যায়। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে সে মানের বইগুলো সব শ্রেণীর পাঠকের প্রধান খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনভাবে দেশের পাঠক সমাজ সে সব লেখায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে কোনো কোনো লেখক দম্ভ করে সিরিয়াস লেখাকে, সমাজের চিত্র তুলে ধরার প্রয়াসকে টিটকারি-টিপ্পনি কাটেন। তাঁদের মন্তব্য শুনলে মনে হয় বই পড়া মানে হলো কিছু ভাঁড়ামো পড়া। অস্বীকার করছি না যে ভাড়ামোপূর্ণ কাহিনী লেখা মেধার কাজ, কঠিন কাজ। অস্বীকার করছি না, আমি নিজেও কদাচিৎ এসব লেখা পড়ি। এক ধরনের উপভোগ করি। কিন্তু একটি পাঠক সমাজ ভাঁড়ামোসর্বস্ব হয়ে যাবে? এসব কারণেই বাংলাদেশের সাহিত্যমান কোথায় চলেছে তার কিছুটা নজির দেখলাম কলকাতা মেলায়। বাংলাদেশের একটি প্যাভিলিয়ন দেখা গেল। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে এবং মেলার মাঝখানে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন। গোটা ১৫ চিরচেনা বাংলাদেশি প্রকাশকের স্টল দেখা গেল। কিন্তু ওই প্রাণবন্ত মেলার মাঝে এসব স্টলে কোনো ব্যস্ততা নেই। প্যাভিলিয়নে ঢুকে দেখলাম প্রতিটি স্টলের সামনে একজন বা দুইজন করে পাঠক বাংলাদেশি বই হাতিয়ে কৌতূহলবশত দেখছে এবং বেরিয়ে যাচ্ছে। ভারি মনে প্যাভিলিয়নের সামনে এসে দাঁড়ালাম। জিনসের প্যান্ট আর টিশার্ট গায়ে স্মার্ট দুই বঙ্গললনা বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন উচ্ছসিত কণ্ঠে বলল, দেখেছিস, বাংলাদেশের স্টল! অন্য মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, লাভ হবে না, কিচ্ছু নেই।
লাভ কোথায় হবে তাও দেখলাম। কলকাতা বইমেলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক শব্দটি আছে। তা শুধু নামসর্বস্ব নয়। ইংরেজি বইয়ের প্রকাশক রূপা অ্যান্ড কোং, পেঙ্গুইন ইনডিয়া, পিয়ারসন দিয়েছে বিশাল সব স্টল। অসংখ্য বাঙালি ইংরেজি বইয়ের পাঠ্য দেখলাম। স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েরা অতুলনীয় আগ্রহ নিয়ে বই বাছাই করছে, কিনে নিচ্ছে। ইংরেজ বা বিদেশি পাঠকরাও সেখানে স্বচ্ছন্দে অংশ নিচ্ছেন। পক্ষান্তরে ঢাকার মেলায় অতি আগ্রহ নিয়ে কখনো কখনো বইপোকা ধরনের কূটনীতিক পাড়ার লোকরা ঢুঁ দেন। তারপর হতাশ হয়ে ফিরে যান। কানা মামা ইউপিএল (নাই মামার চেয়ে না কি কানা মামা ভালো) গুটিকয়েক পুরনো ইংরেজি বই নিয়ে বসে থাকে। এ দুরবস্থা দেখে একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। বাংলাদেশ মাছশূন্য হয়ে গেছে। কোনো কোনো বাজারে দেখা যায়, বহু মানুষ বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘুরছে আর ঘুরছে। মাছ বিক্রেতা ডালার ওপর ছোট এক ভাগ কাচকি মাছ নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে খরিদ্দারদের দিকে তাকাচ্ছে। এমনি, এই মাছের মতো বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার সাহিত্য ও পঠন কি উঠে যাবে?
একসঙ্গে সবাই সরাসরি বিদেশি সাহিত্য-গবেষণা পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে নিজেরা সমৃদ্ধ হব কী করে, কী করে হব আন্তর্জাতিক? বিশ্বের প্রতিটি বইমেলার আশপাশে একটি বইভিত্তিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। আজ কয়েক বছর ধরে ঢাকার বইমেলার বাইরে অসংখ্য নারী-পুরুষকে হাতে হাতে একটি বই বিক্রি করতে দেখা যায়, যার নাম 'দাজ্জাল'। দৃশ্যটি দেখে মনে হয়, জাতি হিসেবে আমরাই 'দাজ্জালে' পরিণত হচ্ছি।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.