উন্নয়ন-প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন by এ এম এম শওকত আলী

সম্প্রতি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আর্থিক বরাদ্দ শতকরা ছয় ভাগ হ্রাস করা হয়েছে। এ ধারা নতুন নয়। বিগত কয়েক দশক ধরেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়। তবে এ বছর উদ্বৃত্ত অর্থের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ ও সমস্যাজর্জরিত খাতে। যেমন, অবকাঠামো, বিদ্যুৎসহ কৃষি খাতে।


প্রকৃতপক্ষে বর্তমান অর্থবছরের সমাপ্তি ঘটবে জুনের ১৫ তারিখে। কারণ জুন মাসের ১৫ তারিখ থেকেই প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সরকারি হিসাবরক্ষক দপ্তর কোনো বিল গ্রহণ করে না। এহেন নিয়মের কারণ, অর্থবছরের শেষ ভাগেই আলোচ্য দপ্তরে সর্বাধিক বিল পেশ করা হয়, যা সময়ের অভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অর্থ প্রদান করতে সক্ষম নয়। এ জন্যই দায়ী করা হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে। অতীতে জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটির নির্দেশে বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ প্রণয়ন করেছিল। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ওই বিভাগ প্রায় ডজনখানেক কারণ এ সম্পর্কে নির্ধারণ করলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। কারণ যথাযোগ্য পরিবীক্ষণ অনুযায়ী সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। এ ছাড়া রয়েছে উপযুক্ত পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থার শূন্যতা।
প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতি মাসে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে পরিবীক্ষণ করার ব্যবস্থার প্রথা চালু থাকা সত্ত্বেও আশানুরূপ উন্নতি নিশ্চিত করা যায়নি। এ জন্য বিভিন্ন মহল থেকে কিছু কারণও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এসব কারণকে প্রধানত দুটি ভাগে বিভাজন করা সম্ভব। এক. প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা। দুই. বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার অভাব। এ দুটি প্রধান কারণের বিভিন্ন প্রকারের অন্যান্য সমস্যাও রয়েছে। বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণটিই সর্বাধিক আলোচিত। সর্বশেষ জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটির সভার সমাপ্তির পরে পরিকল্পনামন্ত্রী এ সম্পর্কে একটি পদক্ষেপের বিষয় উল্লেখ করেছেন। পদক্ষেপটি হলো, ভবিষ্যতে প্রকল্প পরিচালকের নিযুক্তির জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। যোগ্য ব্যক্তিদেরই এ পদে নিযুক্ত করা হবে, যার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, বিদেশি সাহায্যপুষ্ট ঋণচুক্তির আওতায় একটি শর্ত দাতাগোষ্ঠী সংযোজন করে থাকে। এতে বলা হয়, বিদেশি অর্থ প্রদানকারী সংস্থার সন্তুষ্টিসাপেক্ষে সরকার প্রকল্প পরিচালকের নিযুক্তি প্রদান করবে। অর্থাৎ সরকার ও সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থা যোগ্যতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হয়েই এ ধরনের নিযুক্তি নিশ্চিত করে। এর পরও কেন যোগ্যতার অভাবের বিষয়টি মুখ্য? অনুমান করা অযোক্তিক হবে না যে, এ ধরনের শর্ত থাকা সত্ত্বেও যোগ্য ব্যক্তি নিযুক্ত করা সম্ভব হয়নি। অথবা প্রক্রিয়াগত বা জটিল পদ্ধতির কারণে ঈপ্সিত ফল অর্জন করা যায়নি। সুতরাং যে দুটি প্রধান কারণের কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, সে দুটি কারণকেই প্রাধান্য প্রদান করা বাঞ্ছনীয় হবে। কারণ, একটি অন্যটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। একটিকে বর্জন করে অন্যটিকে প্রাধান্য দিলে সুফল পাওয়া সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে আরেকটি বিষয় প্রাসঙ্গিক। তা হলো, শুধু সরকারি নয়, দাতা সংস্থার অর্থ প্রদান করার পদ্ধতিগত জটিলতা। এ কারণটি কোনো সময় সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয় না। তবে ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে অন্তত একটি পত্রিকা এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিল। প্রকাশিত সংবাদে কৃষি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত একটি মুখ্য দাতা সংস্থার প্রয়োজনয়ী অর্থ ছাড়ের বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুতরাং পদ্ধতিগত জটিলতা পর্যালোচনা করার সময় দুটি উৎসকেই সমগুরুত্ব প্রদান করা ফলপ্রসূ হবে।
দাতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রায়ই সরকারের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অভিযোগ করে এ ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীভূত করার পক্ষে পরামর্শ প্রদান করা হয়। অথচ তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা যে সরকারের তুলনায় অধিকতর কেন্দ্রীভূত সে বিষয়টি আড়ালেই থেকে যায়। সব ধরনের ক্ষেত্রে পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, দেশের বাইরে সদর দপ্তরের অনুমতি তাদের গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
অন্যদিকে, একটি প্রকল্পের মোট বরাদ্দ করা অর্থের প্রথম তিন কিস্তি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই প্রকল্প পরিচালকের জন্য ছাড় করার জন্য ক্ষমতাবান। সর্বশেষ কিস্তি ছাড় করার জন্য প্রথম তিন কিস্তির হিসাব সমন্বয় করার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা হিসাবব্যবস্থার শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তিযুক্ত। তিন কিস্তির হিসাব মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ বিভাগকে দেওয়ার পর চতুর্থ কিস্তি ছাড় করা হয়। সুতরাং বলা যায় যে, সরকারি প্রথা অনেকাংশে বাস্তবসম্মত ও বিকেন্দ্রীভূত। কিন্তু এ প্রক্রিয়া কত কম সময়ে সম্পন্ন করা হয়—এ বিষয়টি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও সাধারণভাবে এ কথা বলা যায় যে, সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকসহ মন্ত্রণালয়ের দক্ষতার ওপরই গতিশীলতা নির্ভরশীল। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, মন্ত্রণালয়ভেদে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে যথেষ্ট তারতম্য বিদ্যমান। সাধারণত অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যবহারের মাত্রা মোটামুটি সন্তোষজনক। অন্যান্য ক্ষেত্রে এ বিষয়টি নিশ্চিত করা সংগত কারণে সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি খাতে কিছু প্রকল্পে এনজিওদের সম্পৃক্ত করা হয়। সাধারণত কৃষক দল গঠন, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ সীমিত ক্ষেত্রে কৃষিঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রায়ই বিলম্ব পরিহার করা সম্ভব হয় না।
আলোচ্য ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হলো নির্ধারিত যোগ্যতার মাঠকাঠি অনুযায়ী এনজিও নির্বাচন। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যোগ করা যায় বিদ্যমান ‘তদবির সংস্কৃতি’। এর ফলে প্রকল্প পরিচালক পর্যায়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। প্রকল্প পরিচালকের পক্ষ থেকে প্রস্তাব মন্ত্রণালয় পর্যায়ে প্রেরণ করার পর শুরু হয় ‘তদবির সংস্কৃতি’র দ্বিতীয় দফা চাপ। তৃতীয় ধাপ শুরু হয় সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থার পর্যায়ে। এ সংস্থায় প্রেরিত হয় অনেক অভিযোগ। এসব অভিযোগের ওপর ওই সংস্থা মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ করে থাকে। মন্ত্রণালয়ও রুটিনমাফিক এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের অভিমত গ্রহণ করে দাতা সংস্থাকে অবহিত করে।
অর্থছাড়ের জন্য প্রকল্প পরিচালকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও অতীত অভিজ্ঞতার অভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। কারণ, অর্থ বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত ছক পূরণের পূর্ব অভিজ্ঞতা আবশ্যক। এ সমস্যা উত্তরণের জন্য বিষয়টি নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিষয়ে কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। মন্ত্রণালয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তা নিয়োগ একান্তই জরুরি। এ বিষয়ে রয়েছে দুটি প্রতিবন্ধকতা। এক. ইতিপূর্বে উল্লিখিত ‘তদবির সংস্কৃতি’, দুই. নিয়োগ প্রদানকারী মন্ত্রণালয়ের বদলির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের সুস্পষ্ট নীতি এবং তা বাস্তবায়নের স্বাধীনতা। কয়েক বছর আগে সচিবালয়ে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে একটি ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট উইং সৃষ্টি করা হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ার অন্য একটি উইংও রয়েছে। এর ভূমিকাই মুখ্য। দুটি প্রশাসনিক স্তরের মধ্যে কতটুকু সমন্বয় বিদ্যমান তা বিবেচনার দাবি রাখে।
এ ছাড়া প্রয়োজন রয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ই যোগ্য কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে নিযুক্তির বিষয়ে উদাসীন। এ বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরেই নেওয়া হয় যে, এ দায়িত্ব সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের। অন্যদিকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সাধারণভাবে কোনো নির্দিষ্ট কর্মকর্তাকে নিয়োগের জন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে অনুরোধ পায় তা পছন্দ করে না। উভয় পক্ষকেই পারস্পরিক সহনশীলতা ও বিচক্ষণতার বিষয়ে অধিকতর যত্নবান হতে হবে। মূল বিষয়টি যোগ্যতা ও পূর্ব-অভিজ্ঞতার সঠিক মূল্যায়ন করা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ প্রদানের অনুরোধ সমর্থনযোগ্য নয়। এ বিষয়ে ন্যূনতম তিনজন কর্মকর্তাকে নিয়োগের জন্য অনুরোধ জানানো বাঞ্ছনীয় হবে। শুধু ওই সব কর্মকর্তাকে নিযুক্তির অনুরোধ করা হবে, যাদের প্রচলিত তিন বছর সময় অন্য মন্ত্রণালয়ে অতিবাহিত হয়েছে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।

No comments

Powered by Blogger.