ব্যাংকিং খাত-তারল্য সংকট দূর করার উপায় by বোরহান উদ্দিন

আমাদের দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নানামুখী সমস্যায় পড়েছে। দেশের প্রায় সব খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও এফবিসিসিআই প্রকাশ করেছে, ব্যাংকের নগদ টাকার তারল্য সংকটের কারণে নানা অসুবিধা সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো ব্যাংক হাজার কোটি টাকা বা তারও বেশি তারল্য সংকটে ভুগছে। এ সংকটের পেছনে কয়টি বাস্তব কারণ রয়েছে।


প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী সিআরআরে পূর্বনির্ধারিত হারের চেয়ে বর্তমানে আরও বেশি হারে (০.৫০%) ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ টাকা গচ্ছিত রাখতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় নেমে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের বড় বড় অঙ্কের (শত ও হাজার কোটি টাকা) অর্থ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন প্রকার ঋণ সিসি (হা.) (প্লেজ) লিম, এলটি আরএসওডি ইত্যাদি নগদে ক্রয় করে নিজ ব্যাংকে নিয়ে আসার জন্য ঋণগ্রাহকের নামে বকেয়া অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে খেলাপি বকেয়া ঋণের স্থিতি নগদে পরিশোধ করে ঋণগ্রাহক সৃষ্টি করতে গিয়ে নগদ টাকা চলে যাওয়া। পরে এ ঋণ সঞ্চালন ঋণ হিসেবে পরিগণিত না হওয়া এবং বকেয়া থাকার পরিপ্রেক্ষিতে নগদ টাকা সরবরাহ কমে যাওয়া।
তৃতীয়ত, বিতরণকৃত ঋন মঞ্জুরির শর্তানুযায়ী লেনদেন না করা।
চতুর্থত, খেলাপি ও শ্রেণীকৃত ঋণ বিশেষ করে বড় অঙ্কের ঋণ আংশিক অর্থ বা পুরোপুরি নগদ আদায়ের অগ্রগতি পরিলক্ষিত না হওয়া।
পঞ্চমত, সঞ্চয়কারীদের সব ধরনের আমানতের ওপর লাভ বা সুদের হার কম দেওয়া। ব্যাংকে নগদ টাকা বা তরল সম্পদ রাখার প্রতি দৃষ্টি না রেখে ঋণ বিতরণ করা। ফলে নগদ টাকার সরবরাহ কমে যায়।
সপ্তমত, সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকের মনলোভী হারে লাভ সুদ প্রদানের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ। সরকারি ব্যাংক ইচ্ছা করলে করতে পারে না। ফলে সরকারি ব্যাংক থেকে নগদ টাকা চলে যায়। অষ্টমত, তহবিল ব্যবস্থাপনার মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নগদ টাকার চাহিদা ও সরবরাহে অনভিজ্ঞতা।
নবমত, ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলন করে তাৎক্ষণিক দ্বিগুণ লাভের আশায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ। গ্রাহকসেবায় উদাসীনতা ও আমানত সংগ্রহে অনাগ্রহ। ব্যাংক থেকে টাকা নগদ উত্তোলন করে শেয়ারবাজরে বিনিয়োগের ফলে ব্যাংকে অর্থ আর ফেরত না আসা। ২০১০ সাল থেকেই বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের নগদ টাকা বা তারল্য সংকট অল্প অল্প করে হতে থাকে, যা বর্তমানে প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ভালো-মন্দ নির্বিশেষে অধিক মুনাফা করার লক্ষ্যে যেসব ঋণ দিয়েছে, তার অধিকাংশই আর ফেরত না আসার কারণে ক্রমান্বয়ে ব্যাংকে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। ২০০৯ সালে কুঋণের পরিমাণ ২৩ শতাংশ ছিল। আইটেম অডিটের নীতি অনুযায়ী শুধু কুঋণ নিরীক্ষা করলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের হার আরও অধিক হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজার ছাড়াও কোটি টাকা ডলারের বেচাকেনাও তথৈবচ অবস্থা। ডলারের ঊর্ধ্বমুখী তৎপরতায় এ ক্ষেত্রে যে বেচাকেনা হয়েছে, সে টাকা সংশ্লিষ্টদের হাতে রয়ে গেছে, যা আর ব্যাংকগুলোতে ফেরত আসেনি। নগদ লেনদেনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী শেয়ার ও ডলারে বেচাকেনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ ও অন্যদের হাতে নগদ আছে প্রায় ৫২-৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা আগের সময়ের চেয়ে প্রায় ১১-১২ হাজার কোটি টাকা বেশি।
মুদ্রাস্টম্ফীতির হারও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। মুদ্রাস্টম্ফীতির দরুন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। নির্দিষ্ট আয়ের লোকজনের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে প্রকৃত আয় কমে যায়। ফলে সঞ্চয়ের অনাগ্রহের কারণে ব্যাংক সঞ্চয়ের জন্য টাকা জমা করাও কমতে থাকে। সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে নগদ অর্থেরও অভাব সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ এক হাজার ১৩০ কোটি ডলার এবং এর পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলে মন্তব্য করেছে। রফতানি আয়ও বিগত বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
তাহলে মুদ্র্র্র্রা-বিনিময় বাজারব্যবস্থা ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা কেন বিরাজিত?
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে, 'ব্যাংকে তারল্য সংকট', মানুষের হাতে হাতে টাকা। এতে ব্যাংকগুলো কী অবস্থায় আছে, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
উচ্চহারে সুদে আমানত গ্রহণ করলে ব্যাংকের অপারেটিং কস্ট বেড়ে যাওয়ার কারণে অগ্রিমের ক্ষেত্রেও সুদের হার বেড়ে যাবে। তাতে আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় ও দেশজ উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যাবে এবং এতে মুদ্রাস্টম্ফীতির হারও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। এ থেকে উত্তরণ কীভাবে ঘটবে, তা নিয়ে আমার প্রস্তাব :১. আমানত বৃদ্ধিতে সঞ্চয়ের মনোভাবে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্যাকেজ ঘোষণা। ২. ভারতে ১৪টি সরকারি ব্যাংক রয়েছে। তার মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকও একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। ওই ব্যাংক তাদের আমানত বৃদ্ধিকল্পে প্রত্যেক হিসাবধারী যাদের নূ্যনতম পাঁচ হাজার টাকা সঞ্চয়ী হিসাবে জমা রয়েছে, তাদের সমপরিমাণ ইস্যুরেন্স কভারেজ দিয়ে আমানতকারীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো এ নীতিমালা গ্রহণ করতে পারে। ৩. দ্রুত তারল্য সংকট দূরীকরণের স্বার্থে বিশেষ স্কিম হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মাসিকভিত্তিক প্রতি এক লাখ টাকায় এক হাজার টাকা মুনাফা দিয়ে স্থায়ী আমানত খোলা যেতে পারে। ৪. ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সিসি ঋণসহ (প্লেজ) আমদানি-রফতানি খাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিতরণকৃত যেমন লিম এলটি আর এলসি ইত্যাদিতে প্রদানকৃত অগ্রিম দ্রুত আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এরই মধ্যে সব বিতরণকৃত ঋণ বিশ্লেষণ করে গুদামজাতকরণ শ্রেণীতে বিতরণকৃত ঋণ খাতে মঞ্জুরিপত্রের শর্ত মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংকে পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ। ৫. সব বিতরণকৃত ঋণের ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে ঋণসীমা কমিয়ে দিয়ে আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ঋণসীমা সংক্রান্ত নীতি গ্রহণ করে ১০ বা ১৫ শতাংশ হারে মোট মঞ্জুরি ও বিতরণকৃত ঋণ আদায় করে অগ্রিমের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া। শীর্ষ খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে দ্রুত নগদ টাকা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য তারল্য সংকট দূর করতে। ৬. অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কৃষিঋণ বরাদ্দের বাইরেও কোটি কোটি টাকা বিতরণ করে থাকে। এ প্রবণতা দ্রুত বন্ধের ব্যবস্থা করে প্রকৃত ঋণ গ্রহণকারীদের যাচাই-বাছাই করে ঋণ বিতরণ। ৭. আমেরিকার মতো আমাদের সরকার সরকারি ট্রেজারি ফান্ড থেকে অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক আপদকালীন ও স্বল্প সময়ের জন্য স্বল্প সুদে যেসব সরকারি ব্যাংকের তারল্য সংকট অব্যাহত আছে, তাদের সে পরিমাণ টাকা ঋণ হিসেবে দিয়ে বর্তমান তারল্য সংকট থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোকে রক্ষাকল্পে সহযোগিতা করা একান্ত প্রয়োজন। না হয় বিরাট অঙ্কের তারল্য সংকট থেকে উত্তরণ কষ্টকর হয়ে পড়বে। জনস্বার্থে আবশ্যক খাতগুলো ছাড়া অন্যান্য খাতে ঋণ বিতরণ কমিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ৮. তহবিল ব্যবস্থাপনায় দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ করা।
৯। শেয়ারবাজারে উত্থান ঘটিয়ে সাধারণ মানুষ, যাদের ব্যাংকে সঞ্চয় ছিল, তা উঠিয়ে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে খাটিয়েছে, যা ব্যাংকে ফিরে আসেনি। ব্যাংকগুলো লোভনীয় প্যাকেজ ঘোষণার মাধ্যমে এ টাকা ব্যাংকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারলেও তারল্য সংকটের অভাব ঘুচানো যাবে।

বোরহান উদ্দিন: ব্যাংকার
borhanuddin 09@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.