বৃক্ষরোপণ-‘বিমূর্ত’ পাওলোনিয়া প্রকল্প by মোকারম হোসেন

ধরা যাক, আপনার একটুকরো জমিতে এত দিন শাকসবজি বা ফল-ফলাদি ফলেছে। কিন্তু আপনার অনুপস্থিতিতে সেখানে হঠাৎ করেই স্বজনেরা ইউক্যালিপটাস আর একাশিয়াগাছ বুনে দিয়েছেন। এ কাজটি করার পর সেখানকার প্রকৃতিতে যে সূক্ষ্ম পরিবর্তন সূচিত হলো তা কিন্তু আপনার অগোচরেই থেকে গেল।


অথচ আগে অনেক পরাশ্রয়ী কীটপতঙ্গ, তৃণগুল্ম ও পাখিদের আশ্রয় ছিল সেই একটুকরো বাগান। এখন নিচে ঘাস নেই, তৃণ-গুল্ম নেই, নেই মাটির সজীবতা। ফলে খাবার নেই বলে সেখানে আর পোকামাকড় বা পাখপাখালিরাও আসে না। খাবারের অভাবে ওরা পাড়ি জমায় অন্যত্র। প্রকৃতির এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নষ্ট করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের দেশে সেই কাজটিই হচ্ছে অহরহ।
আমাদের এমন অনেক পুরোনো ক্ষতির সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও নতুন নতুন বিধ্বংসী কাজ। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা ডেসটিনি বাণিজ্যিকভাবে পাওলোনিয়া নামে একটি বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়। সরকারের যথাযথ কোনো অনুমোদন না নিয়েই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষদের বৃক্ষরোপণভিত্তিক কিছু প্যাকেজের কথা বলে অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে ইতিমধ্যেই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। গত ১ এপ্রিল প্রথম আলোয় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েক বছর আগে এই কার্যক্রম শুরু করলেও ২০১১ সালে কেবল সরকারের অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। তবুও প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। গাছ রোপণের দুটি প্যাকেজের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ওরা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করলেও বাস্তবে এসব গাছের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। অনেক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা এখনো কোনো গাছ দেখতে পাননি। পুরো বিষয়টিই এখনো রহস্যের ঘেরাটোপে বন্দী। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ঘোষণাপত্রে বান্দরবান, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, কুয়াকাটাসহ ৩০টি স্থানে যে বৃক্ষ সৃজনের কথা মানুষকে বলেছে, তার জন্য ৭০ হাজার একর জমি প্রয়োজন। কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় এ ধরনের জমি কেনার সুযোগ নেই। অন্যের কাছ থেকে ভাড়া করে বনায়ন করলেও বিক্রির ক্ষেত্রে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগে। সেই অুনমতিও তাদের দেওয়া হয়নি। বন বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাওলোনিয়া মূলত চীনের গাছ। সেখানে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার স্থানগুলোতে দ্রুত বর্ধনশীল হিসেবে গমখেতে এ গাছ লাগানো হয়। জ্বালানি ছাড়া এ গাছের কোনো ধরনের মূল্য নেই। তা ছাড়া গাছটি বাণিজ্যিকভাবে চাষের ক্ষেত্রেও বন বিভাগের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় সাংবাদিক ও একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে পঞ্চগড় জেলার ভারত সীমান্ত লাগোয়া আটোয়ারী উপজেলার ছেপড়াঝাড় মৌজায় প্রতিষ্ঠানটি এক কোটি ১৩ লাখ টাকা মূল্যে চার পরিচালকের ব্যক্তিগত নামে ৪২ একর জমি ক্রয় করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেখানে কোনো বৃক্ষ রোপণ করা হয়নি। একইভাবে অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বান্দরবান জেলায়ও বৃক্ষায়নের জন্য ডেসটিনির কোনো বৈধ জায়গা নেই। একাধিক প্রশাসনিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান ও নাইক্ষ্যংছড়ির ইউএনও শামীম সোহেল বলেছেন ডেসটিনির বনায়নের ব্যাপারে দাপ্তরিকভাবে তাঁদের কোনো কিছু জানা নেই। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ফয়েজ আহমদ জানিয়েছেন, ডেসটিনির নামে বান্দরবানে কোনো জায়গাজমি নেই। রাবার ও হর্টিকালচারের জন্য বরাদ্দের ইজারা করা জমি কোনো ইজারাদারের কাছ থেকে প্রশাসনকে অবহিত না করে ডেসটিনি যদি নিয়ে থাকে, তাহলে তা অবৈধভাবে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ডেসটিনির প্রতিনিধিরা কয়েকটি স্থানে স্থানীয় লোকজনের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ডেসটিনি কুয়াকাটার কাউয়ারচর এলাকায় কয়েক বছর আগে কিছু বিতর্কিত জমি ক্রয় করে সেখানে শুধু আকাশমণিগাছ রোপণ করেছে। সেখানেও কাঙ্ক্ষিত গাছটির কোনো হদিস মেলেনি। ওই তিনটি পৃথক অনুসন্ধান থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট, প্রতিষ্ঠানটি যে পাওলোনিয়া বৃক্ষের কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থকড়ি সংগ্রহ করেছে, তা প্রকৃত অর্থেই শুভঙ্করের ফাঁকি।
প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা যতই সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন, তাতে কোনো লাভ নেই। বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে এই প্যাকেজটি একটি শুভংকরের ফাঁকি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্রেফ প্রতারাণা। এটি একটি অপরাধ। আর এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোনো ধরনের গবেষণা বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই বিদেশি বৃক্ষ আমদানির অপরাধ। কোনো বিদেশি গাছ চাষাবাদের জন্য আনতে হলে তা কয়েক বছর ধরে বন গবেষণাকেন্দ্রের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর যদি মনে হয় যে গাছটি প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য হুমকি নয়, তাহলেই কেবল চাষাবাদের জন্য বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু জানামতে, ডেসটিনি ওই বৃক্ষটি নিয়ে এমন কোনো গবেষণা করেনি। তা ছাড়া বড় পরিসরে বিদেশি গাছ এনে চাষাবাদের জন্য সরকারের যে পূর্বানুমতি প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটি খোলাসা করে কিছু বলছে না। তবে সবকিছুর আগে এ গাছের বীজ বা চারা আমদানির ক্ষেত্রে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলো কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তা ছাড়া কী পরিমাণ চারা বা বীজ আমদানি করা হলো, তার কি সঠিক কোনো তথ্য সরকারের কাছে আছে? জানামতে, কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ আমদানির ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন রুল (রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধকল্পে মানুষ বা প্রাণীকে আটক বা আলাদা রাখার ব্যবস্থা) মেনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হয়। কারণ, আমদানি করা পণ্যটি কোনো ক্ষতিকর জীবাণুও বহন করতে পারে। যা থেকে বিভিন্ন ধরনের রোগ সংক্রমণ হতে পারে। দেশের প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের ক্ষেত্রে এর চেয়ে আত্মঘাতী কাজ আর কী হতে পারে। আমাদের বন পাহাড়ের নিজস্ব বৃক্ষ ও তৃণ-গুল্ম সাফসুতরো করে সেখানে বিদেশি বৃক্ষের চাষাবাদ কোনোমতেই কাম্য নয়। এমন ভাবনা কেবল অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিরাই ভাবতে পারেন।
বৃক্ষরোপণের কথা বলে ডেসটিনি মূলত দুটি বড় ধরনের অপরাধ করল। একটি হলো, সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা এবং অন্যটি কোনো গবেষণা ছাড়াই বিদেশি বৃক্ষ এনে দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করার চেষ্টা। এই দুই অপরাধের দায়ে তাদের অবশ্যই অভিযুক্ত করা যায়, উপযুক্ত শাস্তিও দেওয়া যায়। কারণ, দেশ ও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার কোনো অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক- তরুপল্লব।
tarupallab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.