ভারত-সৌদি সম্পর্ক-নতুন অংশীদারি ও পশ্চিম এশিয়ার স্থিতাবস্থা by বিজয় প্রাসাদ

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পর সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ কবুল করেন, বিদ্যমান অবস্থা স্থায়ী নয়। আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ, লেবানন ও গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ, পাশাপাশি ইরানের প্রতি যুদ্ধরাষ্ট্রের দেমাগি মনোভাবের ফলে আরবের জনগণ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। তাই সৌদি সুলতানেরা চাপের মধ্যে।


যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট বলে পরিগণিত হওয়া চলবে না, আবার বিচ্ছিন্ন হওয়াও যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রে সৌদিবিরোধী মনোভাবের জন্য রাজপরিবারের সদস্যরা শঙ্কিত। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বড় একটি অংশকে সৌদি ঘাঁটি থেকে কাতারে স্থানান্তর করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এরপর বাগদাদের ভার অর্পণ করে শিয়াদের রাজনৈতিক দলের হাতে। এসব দলের আবার ইরানের সঙ্গে দহরম মহরম। সৌদি রাজপরিবারের সদস্যরা রাজনৈতিক অর্থে এখন আর ওয়াশিংটনের উষ্ণ আলিঙ্গন পান না।
অর্থনৈতিক দিক থেকে অবস্থাটা আরও নাজুক। ‘নির্মল জ্বালানি’ নিয়ে কথাবার্তায় সৌদি আরব ভীত। যুক্তরাষ্ট্রের তেলনির্ভরতা উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে গেছে। নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলা ও সৌদি আরব এখন যুক্তরাষ্ট্রে তেলের প্রধান তিন জোগানদাতা রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত; এটি আর আরব উপত্যকার সরাসরি সুরক্ষা দেয় না। অন্যদিকে, বুশের সময়ে গঠন করা হয় আফ্রিকান কমান্ড (আফ্রিকম)। এর চৌহদ্দী আফ্রিকার তেল ক্ষেত্রগুলোর নিরাপত্তা বলেই মনে হয়। সর্বোপরি, তেলের ভান্ডার যেহেতু অসীম নয়, তাই সৌদি অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করার প্রয়োজন তো আছে।
যদি ওয়াশিংটনমুখী না হওয়া যায়, তাহলে আবদুল্লাহর প্রস্তাব হলো ‘পূর্বমুখী’ হওয়া। রিয়াদের রাজপ্রাসাদের ভেতর আবদুল্লাহ সবসময় ছিলেন ওয়াশিংটনের পক্ষের প্রধানতম ব্যক্তি। কিন্তু সিংহাসনে আরোহণের পর আরেকটু সতর্ক হয়ে তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সুলতানের কথা শুনছেন। গত তিন দশকে সৌদি আরবের কাছে চীন মিসাইল প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। এসব চুক্তিতে পৌঁছার ক্ষেত্রে উপসাগরকেন্দ্রিক চীনের আকাঙ্ক্ষাকে সুলতান স্বস্তিদায়ক হিসেবে দেখেছেন। সৌদির তেলের প্রধান ক্রেতা এখন চীন। আরব উপদ্বীপে প্রযুক্তিবিষয়ক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে চীন। সৌদি অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার ক্ষেত্রে এটি সহায়ক হতে পারে। সৌদির তেল কোম্পানি আরামকো তাদের সম্পদ ও দক্ষতা প্রয়োগ করছে চীনের পেট্রোলিয়াম পরিশোধন খাতে। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে আবদুল্লাহ বেইজিং সফর করেন, এর পরপর হু জিনতাও আরব উপদ্বীপ সফরে আসেন এপ্রিলে। বাদশাহর উপদেষ্টা পরিষদ, শুরায় তিনি বক্তৃতা দেন। খুব কম সংখ্যক বিদেশি নেতা এমন সুযোগ পান। আবদুল্লাহ তখন থেকে চীনাদের ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করছেন। এতদিন শুধু মুসলমানদের জন্যই রিয়াদ এ শব্দটি সংরক্ষিত রেখেছিল।
বাদশাহ আবদুল্লাহ ২০০৬ সালে চীন সফরের সময় ভারত হয়ে যান। তিনি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান অতিথি হন। একটি ধর্মরাষ্ট্রের বাদশাহকে করা হয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রী সংবিধান উদ্যাপন অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি।
১৯৯১ সালে নব্য-উদারনৈতিক রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি অঙ্গীকার এবং জোট নিরপেক্ষতা থেকে সরে ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকে পড়ার মধ্য দিয়ে ভারতে নতুন ‘সংস্কার’ যুগের সূচনা হয়। মনমোহন সিং অর্থ মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে সংস্কার-প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেন। উদারীকরণের প্রক্রিয়াটি তৃতীয় বছরে পা দেওয়ার পর মনমোহন সৌদি আরব যান। ভারতের অর্থমন্ত্রী ও ব্যবসায়ীরা তখন বুঝতে পেরেছিলেন, দেশটির ক্রমবর্ধিষ্ণু জ্বালানির চাহিদা মেটানোর জন্য নতুন পথের সন্ধান পেতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ওয়েল অ্যান্ড ন্যাশনাল গ্যাস করপোরেশনকে (ওএনজিসি) পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করা হলো। এটি তখন পারস্য উপসাগর থেকে সাখালিন দ্বীপ পর্যন্ত তেল অনুসন্ধান শুরু করল। কিন্তু ওএনজিসির প্রাপ্তিই যথেষ্ট হতো না। মনমোহন ইন্দো-সৌদি জয়েন্ট কমিশনে বক্তৃতা দিতেগেলেন। সেখানে ভারতের জন্য কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল জ্বালানি সম্পদ আর সৌদির জন্য দেশটির অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করা। কিন্তু কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের পক্ষে সৌদি আরবের অবস্থান, আফগানিস্তানের জটিল পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশের ভিন্নমুখী অবস্থান ইত্যাদি নানা সমস্যার কারণে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া থেমে যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রয়োজন রাজনৈতিক পার্থক্যকে পাশে ঠেলে দেয়। শিগগির কিছু কিছু বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছে দুটি দেশ। মনমোহনের রিয়াদ সফরের পরপর দুই দেশের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি সফর চলে এবং তেলের প্রবাহও বাড়ে। ২০০৬ সালে আবদুল্লাহ দিল্লিতে আসেন। ‘দিল্লি ঘোষণা’য় স্বাক্ষর করেন। অবাধে তেলের প্রবাহ আসতে থাকে। ভারতে অশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় চালান আসে এখন সৌদি আরব থেকেই, ২০০৮ সালে যার অর্থমূল্য ছিল ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় এসে কৌশলগত এক ভুল করে। ফলে এ সম্পর্ক হোঁচট খায়। তারা ভেবেছিল, তেল আবিব হয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কই সবচেয়ে ভালো হবে, আর সৌদির তেলের অর্থনীতির চেয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ জন্য ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ইসরায়েলের সঙ্গে আঁতাত করে। সৌদি রাজপরিবার এতে ক্ষিপ্ত হয়। ২০০৪ সালে মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই কৌশলগতভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সৌদি আরবের সঙ্গে অপরিহার্য মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তেল ও প্রযুক্তি বিষয়ে এ মিত্রতা।
সম্প্রতি মনমোহন রিয়াদে বিজয়দীপ্ত প্রত্যাবর্তন করেন। হু জিনতাওয়ের মতো মনমোহনও শুরায় ভাষণ দেন। বাদশাহ আবদুল্লাহ তাঁকে ‘ভাই’ হিসেবে নয়, ‘প্রিয়তম বন্ধু’ বলে গ্রহণ করেন। তেল, পুঁজি ও প্রযুক্তির বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মনমোহনের দীর্ঘতম করমর্দনটি ছিল তেলমন্ত্রী আলি আল নাইমির সঙ্গে।
দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় বিশ্ব রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ উঠে এলেও কেন্দ্রে ছিল অর্থনীতি। সৌদি পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বে থাকা প্রিন্স সৌদ আল ফয়সাল বলেন, পাকিস্তান বাজে সময় অতিক্রম করছে। সেখানে ‘বিপজ্জনক ব্যাপার’ ঘটছে। এতে সৌদি আরব উদ্বিগ্ন।
ভারত ও সৌদি আরবের নতুন অংশীদারি থেকে স্পষ্ট যে ভারত এখন পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা মেনে নিয়েছে। এতদিন সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের দূরত্বের মূলে ছিল আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি ভারতের বিশ্বস্ততা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই আন্দোলনের প্রধান নেতা গামাল আবদুল নাসের সৌদি রাজপরিবারের বড় শত্রু ছিলেন। আরব জাতীয়তাবাদের অবসান এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রূপান্তর ঘটার ফলে এখন দুই শক্তির হাত মেলানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত। আবদুল্লাহ পূর্বমুখী হয়েছেন, তাঁর চাওয়া এশিয়ার দুই শক্তির কাছ থেকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সহায়তা। মনমোহন দেশে ফিরলেন প্রচুর তেল নিয়ে। আরব প্রজাতন্ত্র গড়ার স্বপ্ন চুরমার। ভারত একসময় এই চিন্তার মিত্র ছিল।
কাউন্টার পানচ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
বিজয় প্রাসাদ: ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক, ট্রিনিটি কলেজ, হার্টফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্র।

No comments

Powered by Blogger.