চারদিক-নিঝুম দ্বীপের চরে by সাইফুদ্দিন রবিন

হুট করেই ঠিক হয় গন্তব্য। ছুট দেব নিঝুম দ্বীপে। আসলে কতটা নিঝুম আর নিস্তব্ধ কিংবা কতটা সুন্দরের দেখা মিলবে দূরের সেই দ্বীপে—তা অনিশ্চিত। নিশ্চিত যাত্রার চেয়ে সেই অনিশ্চিত যাত্রার আহ্বান দমাতে পারেনি। দেশের মানচিত্রের একেবারে দক্ষিণে চোখ রাখলেই দেখা মিলবে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের। সেই দ্বীপের মধ্যেই আরেকটি দ্বীপ।


নাম নিঝুম দ্বীপ। সুন্দর এই দ্বীপের দিগন্তজুড়ে হরিণের অবিরাম ছোটাছুটি আর ভিড়। কিংবা সবুজ পাতার আড়ালে নানা রংবেরঙের পাখির লুকোচুরি খেলা আর শিস দিয়ে গান আপনাকে মাতাল করে ছাড়বেই। কিন্তু এই দ্বীপের গল্পটা কেবল সুন্দরের না। সংগ্রামেরও।
হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার দুটি পথ রয়েছে। তার একটি হলো জাহাজমারা সিডিএসপি বাজার থেকে ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপের চরে। তারপর সেখান থেকে রিকশায় কিংবা পায়ে হেঁটে আরও দূরের মূল পর্যটন এলাকা। সুন্দরের সন্ধানে সারা দেশ থেকে অগণিত মানুষ যখন ছুটে যায়, তখন দ্বীপের কয়েক শ পরিবার বেঁচে থাকে দুঃসহ যাতনা আর কষ্ট বুকে নিয়ে। নিঝুম দ্বীপের চরে পা রাখলে চোখ পড়বে শূন্য জমিতে উঁচু ভিটেমাটির ওপর একেকটি ঘর। দূর থেকে সেই বিচ্ছিন্ন ঘরগুলোকে দেখে মনে হবে দ্বীপের ভেতর বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন আরও বহু দ্বীপ। সেই ঘরের বাসিন্দারা মানে এই চরের মানুষের প্রত্যেকেই নদীভাঙনের শিকার হয়ে বসত গড়েছে এখানে। এদের সবার বাড়িই একসময় ছিল হাতিয়ায়। কিন্তু শহুরে মানুষের কাছে যে নদী সুন্দর সেই নদীই রাক্ষুসে হয়ে ধরা দেয় এই মানুষগুলোর কাছে। ভাঙনে বাপ-দাদার ভিটে হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছে নতুন জেগে ওঠা এই পলিমাটির স্তূপে। এখানে নরম কাঁচামাটি শক্ত হয় তাদেরই পথচলায়। তারপর একদিন এখানেই তারা বুনতে শুরু করে স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নই হয়ে থাকে বরাবরের এই হতভাগ্য মানুষগুলোর জন্য। ভূমিহীন এই মানুষেরা বন্দোবস্ত পায় না জমির। আশ্রয় নেওয়া সেই জমি রাষ্ট্র দিয়ে দেয় ধনিক শ্রেণীর হাতে। যাদের এই চরের ভূমি না হলেও বেশ চলে, যাদের টাকা আছে, অথচ তারাও সাজে সহায়-সম্বলহীন ভূমিহীন।
কথা হচ্ছিল এই চরের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব আবুল খায়েরের সঙ্গে। বললেন, ‘গরিব তো আজীবনই গরিব, বাবা। আঙ্গো জমি-জিরাত নাই। সব নদী খাইছে। অন ইয়ানে বাই বাইনছি। হিয়ার হরও ডর লাগে। কুনদিন নদীভাঙন ছাড়াই উডি যাইতে অ। ভূমিহীন অইও জাগা হাইনা আর বাইরের বেডারা টিয়াদি জাগা লইযা’। খাদিজা খাতুন এক কন্যাসন্তান নিয়েই বাস করেন এই চরে। স্বামী হারিয়েছেন বহু আগেই। আর তাগড়া যুবক ছেলে সেলিম বছর তিনেক আগে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ছোট্ট একটা ঘর বেঁধেছেন নিঝুম দ্বীপের চরে। ‘ঘরও খাইলো হোলাও খাইলো নদী। মাইয়া উগ্গালই অন আছি। আঁর জাগা-জইন কিছু নাই আর। ইয়ানে নদীর মধ্যে ভাসি আছি আরি।’—এমন কথা তাঁর মুখ দিয়ে অবলীলায় বের হয়ে আসে।
জীবন এখানে একটু অদ্ভুত রকমের। প্রতিটি মানুষই যেন একেকজন বিপ্লবী আর সংগ্রামী মানুষ। বিচিত্র এই মানুষেরা বেঁচে থাকে মুহূর্তের অনিশ্চয়তায়। নেই কোনো বেড়িবাঁধ। একটু জলোচ্ছ্বাসেই ভেসে যেতে পারে এদের কুঁড়েঘর। ভেসে যেতে পারে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়। নেই কোনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, যেখানে একটু ঝড়ে ঠাঁই মিলবে। তবু এরা লড়াকু। ভয়কে জয় করার দুঃসাহস দেখায় প্রতি মুহূর্তে।
এই মানুষগুলো সহজ। কঠিন অঙ্কের হিসাব মেলাতে শেখেনি কখনো। শুধু জানে বাঁচতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে। এখানকার শিশুদের বেশির ভাগই বাথানের কাজ করে। ভূমিপ্রভুদের মহিষ-গরু-ছাগল লালনের দায়িত্বে ব্যস্ত। কেউ কেউ স্কুলের নাম শোনেনি কখনো, কিন্তু ঠিকই জানে নদী থেকে মাছের পোনা ধরে আনতে না পারলে ঘরে আজ রান্না হবে না। একটা হাসপাতাল তো দূরে থাক, একজন গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারও নেই এখানে।
নিঝুম দ্বীপের চরে একটা চায়ের দোকান আছে। মেঠো রাস্তা ধরে চরের ভেতরে গেলেই শোনা যাবে চায়ের কাপে টুংটাং শব্দ। সেই দোকানে চরের মানুষ আড্ডায় মেতে ওঠে। নিজের সুখ-দুঃখ, ভালোলাগা-ভালোবাসা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। সারা দিনের কর্মক্লান্ত শরীর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আর সস্তা বিড়ির টানে আবার তাজা হয়ে ওঠে। এত কষ্ট আর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও তারা আগামীর পথে চলতে প্রস্তুত।
সাইফুদ্দিন রবিন

No comments

Powered by Blogger.