সমাজচিন্তা-দুদক, ট্রুথ কমিশন এবং আন্নাহাজারে by সরদার আমজাদ হোসেন

দুদক_ দুর্নীতি দমন কমিশন এ দেশের অবৈধ সম্পদ আহরণের মাধ্যমে জনগণের সম্পদ, বিদেশি সাহায্য, অনুদান এবং ঋণের টাকা ব্যক্তিবিশেষ লুটপাট করে তা প্রতিরোধের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংস্থা। ২০০৪ সালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এ প্রতিষ্ঠান জন্ম নেয়।


২০০৭ সালে দুদকের ৩২ ধারা সংশোধন করে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের মতে, দুদককে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত, মোকদ্দমার অনুমতি গ্রহণের যে কোনো সংশোধনী কমিশনকে দুর্বল করবে। বারবার বিভিন্ন আলোচনা সভায়, সংবাদ সম্মেলনে দুদকের দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন। দুদক বর্তমান সরকারের সংশোধিত অর্ডিন্যান্সটি এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়ে আছে।
গত ২০ মে প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দুদককে দুর্বল করা এবং নিয়ন্ত্রণ করার আপত্তি জানিয়েছেন। 'দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদে উত্থাপিত বিলের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে আইন সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ও অর্থ মন্ত্রণালয়।' দুর্নীতির বিরুদ্ধে নজরদারি সংস্থা এ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের উদ্যোগের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষমতা খর্ব করা বলে সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিমত। অর্থমন্ত্রী 'জজ, ম্যাজিস্ট্রেট ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে' সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়ার যে বিধান করা হয়েছে, সে বিষয়ে লিখিত আপত্তি জানিয়েছেন। সংসদীয় কমিটি চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দুদকের ক্ষমতা হ্রাসের বিরোধিতা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো, ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) আইন পর্যালোচনা করে দুদক আইন সংশোধনের চূড়ান্ত করবেন। উদ্যোগটি প্রশংসনীয় এবং যথাযথ।
এসব জাতীয় প্রতিষ্ঠান যদি ঢিলেঢালা হয়, শরীরের শক্তিতে যদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ না নড়ে, লেজের শক্তিতে যদি শরীর নাড়ানো চলতে থাকে তাহলে এ লক্ষ্য অর্জিত হবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পর্যালোচনা উদ্যোগের বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের এ আলোচনায় উঠে আসবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক (বাংলাদেশ), সিবিআই (ভারত), এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা।
বাংলাদেশের বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি ডিভিশন বেঞ্চ হাইকোর্টের বিরুদ্ধে করা একটি লিভ টু আপিল ১৫ মে বিদায় মুহূর্তের কিছু আগে খারিজ করে দেন। 'সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনকে' (ট্রুথ কমিশন) অবৈধ ঘোষণা করেন। ট্রুথ কমিশন জরুরি পরিস্থিতির প্রয়োজনে তৎকালীন সরকার আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আয়বহির্ভূত অর্থ ফেরত দানসাপেক্ষে তাদের মার্জনা করা হয়। এতে অনুকম্পাপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমিশন থেকে ৫৫৬ জন মার্জনা সনদ পান। ট্রুথ কমিশন বাতিলের পর সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক নড়েচড়ে বসেছে। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত দুই শতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দুই শতাধিক স্থগিত মামলা সচল হচ্ছে। আরও দুই শতাধিক মামলা যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্রুথ কমিশনে গিয়ে দায়মুক্তি নিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ যে কোনো আইনে মামলা করা যাবে। একজন রাজনীতিক ও একজন বিচারপতির ছেলেসহ ৪৫২ অবৈধ উপার্জিতসহ ৩৪ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে দায়মুক্তি নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, একজন জাস্টিসই এ কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৮ সালের ভলান্টারি ডিসক্লোজার অব ইনফরমেশন অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়েছে। স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ অর্ডিন্যান্স ২০০৮ তৎকালীন সরকারের ১২১টি অর্ডিন্যান্সের মধ্যে মাত্র ৪৪টি সংসদে পাস হয়। অবশ্যই তার মধ্যে ট্রুথ কমিশনের অর্ডিন্যান্স ছিল না। এতে অর্ডিন্যান্সটি দু'বার গ্রহণযোগ্যতা হারাল। এটিও ছিল দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। অবশ্য বিচারপতি খায়রুল হক একজন আত্মপ্রশংসিত বিচারপতি, যিনি 'পুরো বিচারিক জীবনে বিচারপ্রার্থীদের কথা চিন্তা করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছি।' তার এ নিজ মন্তব্য তাকে একটুও বিবেকবর্জিত মনে হয়নি? তার দুই বছরের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি নাইমুর রহমানকে ডিঙিয়ে তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রধান বিচারপতি করার প্রতিবাদে তারই সতীর্থ পদত্যাগ করলেন। তার সামনের দাঁড়িপাল্লা একদিকে কাত হয়েছিল, তিনি অবশ্যই তা দেখেননি। তাহলে তার 'ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার' স্বপ্রণোদিত ঘোষণা দিতে লজ্জা পেতেন। তিনি একজন মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার। কোন ফ্রন্টের এত বড় যোদ্ধা তিনি?
একথা সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন, ভারতের অবৈধ অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক ভরে উঠেছে। বাংলাদেশ পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হয়েছে। এবারই ৩২ লাখ গ্রাহকের ৪৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ারবাজারে লুটপাট করে একটি সিন্ডিকেট। যারা ক্ষমতাশালী উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিকটজন। বিনিয়োগকারীর বুকফাটা আর্তনাদ, হাজার হাজার অসহায় রিক্ত, সর্বস্ব লুণ্ঠিত মানুষের অসহায় কান্না যখন মতিঝিলের আকাশ ভারী করেছিল, সে কারণেই ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সুতরাং ভারত ও বাংলাদেশের মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতির প্রসার তৃণমূল থেকে লন্ডন, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, কানাডা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই জানেন, শুধু অর্থমন্ত্রী আ মা আ মুহিত একটু হৃদকম্পে ভোগেন। এ কারণেই বাংলাদেশ-ভারতের নাগরিক সমাজে এক বিপ্লবী চেতনার উদ্ভাব ঘটেছে। নাগরিক সমাজ (ঈরারষ ঝড়পরবঃু) যেমন_ টিআইবি, সুজন, হিউম্যান রাইটস কমিশন বাংলাদেশে তৎপর। তারপরও বিলুপ্ত 'ট্রুথ কমিশনের' কর্মকর্তাদের অনুকম্পা পেয়ে চাকরিতে যোগদান করেছেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের শাহাবুদ্দীনসহ এক ডজন ইঞ্জিনিয়ার। তাদের তো মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন। পদ্মা সেতু, চার লেন চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়ক, উড়াল সেতু_ এগুলোর কাজ হবে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বব্যাংক টাকা অবমুক্ত করতে বিলম্ব করে। জলবায়ু তহবিলের জাতিসংঘের কিয়োটো প্রটোকল চুক্তির টাকা না করেছে দুর্নীতি ও অব্যবস্থার কারণে।
ভারতের বিশাল অর্থনীতি দুর্নীতির রাহুগ্রাসে নিপতিত। ভারতীয় প্রথম শ্রেণীর একটি পত্রিকায় স্বপ্রণোদিত জরিপে ইউপিএ সরকারের জন্য সতর্কতা। বিগত ৩৫ বছরের মধ্যে বর্তমান ইউপিএ সরকার সবচেয়ে নিকৃষ্ট দুর্নীতিপরায়ণ, ৯৫ ভাগ মানুষ শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী আইনের পক্ষে। ৯২ ভাগ মানুষ মহারাষ্ট্রের সাবেক গান্ধীবাদী সৈনিক আন্নাহাজারের বিরল প্রতিবাদের পক্ষে।' (অনূদিত : অরুণপরি, এডিটর ইন চিফ, ইন্ডিয়া টুডে) আন্নাহাজারে নামটি এখন ব্যক্তি পর্যায়ে এক দারুণ দুর্নীতিবিরোধী প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। তিনি গত ৯ এপ্রিল সোনিয়া গান্ধীর অনুরোধে দিলি্লর যন্তর-মন্তর চত্বরে দুর্নীতির প্রতিবাদে আমৃত্যু অনশন ভঙ্গ করেন। মাত্র ৯৮ ঘণ্টায় ভারতের ৪৫০টি নগরীতে আন্নাহাজারের বিরল প্রতিবাদে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। জনতার চাপে সরকার নতিস্বীকার করে তার দাবি 'জনলোক পাল বিল' (ঙসনফিংসধহ) পাস করতে প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯৬৫ সাল থেকে এ বিল উত্থাপনের দাবি ছিল। ভারতের সিবিআই আর আগের মতো নেই। এক সময় তারা কংগ্রেস তদন্ত ব্যুরো বা দুর্নীতিপরায়ণ তদন্ত ব্যুরো ছিল। এখন প্রধানমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতে এ রাজার মতো মন্ত্রীকে কারাগারে নিয়েছে। রাজার সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা কায়দায় স্বীকৃতি আদায় করা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের সাবেক মন্ত্রী আরমানি ত্রিপাঠিকে জিজ্ঞাসাবাদে বিরক্তি প্রকাশ করলে তাকে ছোট্ট কামরায় ঢুকিয়ে প্রস্রাবে ভেজানো একটি কম্বল দিয়ে জড়ানো হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বর্তমান সিবিআইর দলিলপত্র দেখে দুদক সংশোধন করেন তাহলে প্রকৃত সত্য বের হবে। সিবিআই এখন স্বাধীনভাবে মন্ত্রী, করপোরেট ক্যাপ্টেন এবং পোক্ত আমলাদের দেশব্যাপী ৪০০ মামলা তদন্ত করছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল টেলিফোন কেলেঙ্কারিতে এক সময়ের ধর্মবিরোধী বর্তমানের ধর্মপ্রাণ ৮৬ বছর বয়স্ক তামিলনাড়ূর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির কন্যা কানিমেঝিকে গ্রেফতার করে তিহার জেলে রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও রতন টাটা, কুমার মঙ্গলাম বিরালা, অনিল আম্বানি, কমনওয়েলথ গেমসের সুরেশ কালামদি, তার নিকট সহযোগী ললিত ভানোট এবং ভিকে ভার্মার মতো বড় বড় রুই-কাতলা সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে বাধ্য হচ্ছে। সুতরাং ভারত এখন নাগরিক সমাজ সিবিআই দুই ফ্রন্টে দুর্নীতিবাজদের ওপর কার্যকর ব্যবস্থায় নেমেছে। বাংলাদেশ পারে না?

সরদার আমজাদ হোসেন :সাবেক মন্ত্রী
 

No comments

Powered by Blogger.