গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ-সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ

গণতন্ত্রের সংকট যেন বাংলাদেশের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। গণতন্ত্র এখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে গিয়ে বার বার ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু আবারও সেই গণতন্ত্রেই ফিরতে হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে, দীর্ঘ আন্দোলন করতে হয়েছে।


কিন্তু তার পরও রাজনৈতিক স্থিরতা নিশ্চিত করা যায়নি। রাজনীতি দুর্বৃত্ত কবলিত হয়নি- এমন কথা হলফ করে বলা যাবে না। তদুপরি এটা মেনে নিতে হবে, এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রকামী। গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষ রক্ত দিতে পারে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে। চেপে বসা স্বৈরশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এ দেশের মানুষ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে। রাজনৈতিক দলের হাতেই বিপন্ন হয় গণতন্ত্র। রাজনৈতিক দল পরমতসহিষ্ণু না হলে মতবিরোধ দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। এই মতবিরোধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন সংঘাত ও সহিংসতা বেড়ে যায়। দেখা দেয় সংকট। এই সংকট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত করে।
অনেক বাধা পেরিয়ে এলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এমনকি ১/১১ নামের চেপে বসা শাসনও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি জাতীয় ঐকমত্যে আনতে পারেনি। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা করা হয়েছিল, তার সূচনা হয়নি। পরমতসহিষ্ণু না হয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো পরিচয় দিচ্ছে একগুঁয়েমি ও অসহিষ্ণুতার। একে অপরের কথা না শোনার এবং মুখ দেখাদেখি বন্ধ করার যে সংস্কৃতি চলে আসছে, তাতে গণতন্ত্র যে এখনো সংকটমুক্ত নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই রাজনৈতিক অবস্থায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফর করে গেলেন। হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফর নানা কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে বাংলাদেশ সম্ভাবনার একটি দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, দুই বছর পর আবার গণতন্ত্রে ফিরে আসা বাংলাদেশের ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি রয়েছে। যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ১/১১ এসেছিল, সেই অবস্থা থেকে গত তিন বছরে কতটুকু বেরিয়ে আসতে পেরেছে বাংলাদেশ?
বিরোধী দলের একটানা সংসদ বর্জন, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে হরতালের ফিরে আসা, আবার ভাঙচুর-গাড়ি পোড়ানো থেকে শুরু করে বেপরোয়া বোমাবাজির ঘটনা থেকে এটা এখন পরিষ্কার, অতীতে দমননীতি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন আনেনি। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো আগের মতোই নিজেদের বৃত্তে আবদ্ধ। বৃত্তের বাইরে আসার কোনো লক্ষণ নেই। এ অবস্থায় গণতন্ত্র আবারও নতুন সংকটের মুখে পড়তে পারে, চলমান সংকট গভীরতর হবে, আবার বিপন্ন হতে পারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা- এমন আশঙ্কা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে তীব্র হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে। দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার ওপর। রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারলে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না। অন্যথায় গণতন্ত্র যে বিপন্ন হতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা আমাদের অতীতে হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন রাজনৈতিক মতভেদ দূর করতে সংলাপের কথা বলেছেন। এটা ঠিক যে, মতপার্থক্য দূর করতে সংলাপের বিকল্প নেই। কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়, দেশের ভবিষ্যৎকে কণ্টকমুক্ত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সংলাপ। সংলাপের ভেতর দিয়ে মতপার্থক্যের শীতল বরফ গলে গিয়ে উষ্ণতা আসবেই। সেক্ষেত্রে সংসদই হতে পারে কেন্দ্রবিন্দু। তবে সংলাপ অনিবার্য। সেই সংলাপ কেবল যে সংসদেই হতে পারে তা নয়, সংসদের বাইরেও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, মতপার্থক্য দূর করা না গেলে বিরাজমান সংকট দূর হবে না।

No comments

Powered by Blogger.