সেচ মৌসুম শেষ, তবু বিদ্যুৎ নেই by আরিফুজ্জামান তুহিন

শহরে তীব্র লোডশেডিং আর মফস্বলে বিদ্যুতের দেখা মেলে কদাচিৎ। গত ফেব্রুয়ারিতে বোরো মৌসুম শুরুর সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সেচ মৌসুম শেষে বিদ্যুতের অবস্থার উন্নতি হবে। সেই মৌসুমের (ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল) সমাপ্তি ঘটেছে প্রায়। তবু বিদ্যুতের অবস্থার উন্নতি হলো না।


জনগণকে শিগগির বিদ্যুৎ-বিড়ম্বনা থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য সরকার বেসরকারি খাতে রেন্টাল ও পিকিং রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে। উচ্চমূল্যের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ১২ থেকে ১৮ টাকা। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করার কারণে সরকারের কোষাগারে টান পড়ে।
এ পরিস্থিতি সামলাতে সরকার দাম চার দফা বাড়িয়েছে। বাড়তি দামেই জনগণ বিদ্যুৎ কিনছে। এর পরও বিদ্যুৎ মিলছে না। বিদ্যুতের নাই হওয়ার কারণও সেই উচ্চমূল্যের পিকিং ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র- এগুলোর বেশির ভাগ বন্ধ থাকছে। জনমনে প্রশ্ন : বিদ্যুৎকেন্দ্রের অজুহাতে দাম বাড়ানো হলো অথচ সেগুলোই বন্ধ থাকছে, তাহলে কেন দাম বাড়ানো হলো?
সেচ মৌসুম শুরুর সময় গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মৌসুম শেষ হওয়ার পর বিদ্যুতের সংকট কমে যাবে। কিন্তু সারা দেশে সেচ মৌসুম প্রায় শেষ। উত্তরবঙ্গের আট জেলায় এখনো কিছু সেচের প্রয়োজন রয়েছে। তবে আগের মতো পানির প্রয়োজন হচ্ছে না। তাই সেচ পাম্পও সেভাবে চলছে না। এর পরও লোডশেডিং কমেনি।
সেচ মৌসুম শেষেও কেন লোডশেডিং জানতে চাইলে পিডিবির মেম্বার (জেনারেশন) তমাল চক্রবর্তী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন গরমের সময়। এখন লোডশেডিং হবেই। এসি ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে গেছে। এ কারণে লোডশেডিংও বেড়েছে।' তিনি বলেন, 'বৃষ্টি হলে লোডশেডিং কমবে। এর জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।'
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, বর্তমানে তিন হাজার ১০০ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে পিকিং ও রেন্টালে এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য কেন্দ্রে যন্ত্রপাতির ত্রুটির কারণে এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। পিকিং ও রেন্টালের এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট মূলত ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলনির্ভর।
রেন্টাল ও পিকিং কেন্দ্রগুলোর অন্তত এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকার কারণ হিসেবে পিডিবি বলছে, প্রতিদিন এ কেন্দ্রগুলো সচল রাখতে সরকারের ৫০ কোটি টাকার জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হয়। পিডিবির অব্যাহত লোকসানের কারণে বাধ্য হয়ে এ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে তমাল চক্রবর্তী বলেন, 'পিকিং ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সব সময় চালানো হয় না। কোনোটা দিনে, কোনোটা রাতে চালানো হয়। সারা দিন চালালে বিদ্যুৎ বেশি উৎপাদন হতো। কিন্তু তাতে খরচ অনেক বেশি পড়ে যেত। এ কারণে পর্যায়ক্রমিকভাবে এসব কেন্দ্র চালানো হয়।'
বর্তমানে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা সাত হাজার মেগাওয়াটের বেশি। পিডিবি চার হাজার ৮০০ থেকে পাঁচ হাজারের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। সূত্র জানায়, পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আট হাজার ৭০ মেগাওয়াট। কিন্তু বেশির ভাগ পিকিং ও রেন্টাল কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে জ্বালানির অভাবে।
পিডিবির তথ্য মতে, গত ৮ মে বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল পাঁচ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। অথচ ওই দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল আট হাজার ৪৯ মেগাওয়াট। গত এক সপ্তাহে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ছিল পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের কম। গত ২২ মার্চ ছয় হাজার ৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশে বিদ্যুতের রেকর্ড উৎপাদন। এর পরই উৎপাদন নেমে আসে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের নিচে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন দপ্তর থেকে কলকারখানায় চিঠি দিয়ে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বোরো চাষে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়। এ কারণে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে শিল্প-কারখানা। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কলকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকছে। আর দিনের বেলায় চার-পাঁচ ঘণ্টার লোডশেডিং তো আছেই।
শিল্পে বিদ্যুৎ নেই, সেচ মৌসুম শেষ। এর পরও বিদ্যুৎ নেই, তাহলে বিদ্যুৎ যাচ্ছে কোথায়? ঢাকার কোথাও দিনরাত মিলিয়ে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। গভীর রাতেও চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ।
মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, লালবাগ, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, গুলশান, বনানী, উত্তরা- ঢাকার সর্বত্রই তীব্র লোডশেডিং।
ধানমণ্ডি ৬ নম্বর রোডের বাসিন্দা আসাদউল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঢাকা মশার শহর, রিকশার শহর। এর সঙ্গে লোডশেডিং যুক্ত করলে ঢাকা এখন লোডশেডিংয়ের শহরও বটে।'
রাজশাহীতে দিনরাত মিলিয়ে বিদ্যুৎ থাকে ১২ ঘণ্টা। একবার গেলে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিদ্যুৎ আসে। দিনে চারবার যায়, আর রাতে বিদ্যুৎ যায় কমপক্ষে দুইবার। বিদ্যুতের অভাবে সেখানকার জনজীবন অতিষ্ঠ। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, রাজশাহীতে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা ৬৪০ থেকে ৬৭০ মেগাওয়াট। পাওয়া যায় ৩৪০ থেকে ৩৬০ মেগাওয়াট।
রাজশাহী বিভাগের পাবনা, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাটে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। এসব অঞ্চলে দিনরাত মিলিয়ে আট থেকে ১০ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ মিলছে না।
বরিশালে শহরে বিদ্যুতের দেখা যাও-বা মেলে, গ্রামে দিনরাত মিলিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা। বরিশালে চাহিদা গড়ে ১৩০ থেকে ১৪০ মেগাওয়াট। পাওয়া যায় ৮০ মেগাওয়াট। জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ থাকে না বললেই চলে। বিশেষ করে ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও পটুয়াখালীতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি শোচনীয়।
খুলনায় বিদ্যুতের পরিস্থিতি ভয়াবহ। দৈনিক চাহিদা গড়ে ৫৮০ থেকে ৬১০ মেগাওয়াট। পাওয়া যায় ৩১০ থেকে ৩২৫ মেগাওয়াট। কয়েক দিন ধরে খুলনায় রাত ১২টায় বিদ্যুৎ চলে যায়, তবে ফিরে আসার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। জেলাগুলোতে পরিস্থিতি আরো খারাপ। যশোর, নড়াইল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, মাগুরায় দিনরাত মিলিয়ে আট থেকে ১০ ঘণ্টার বেশি থাকে না। নড়াইল জেলায় বিদ্যুৎ থাকে মাত্র ছয় থেকে সাত ঘণ্টা।
সিলেটেও তীব্র লোডশেডিং রয়েছে, বিশেষ করে জেলাগুলোতে। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে বিদ্যুতের অবস্থা শোচনীয়। এসব জেলায় কদাচিৎ বিদ্যুতের দেখা পাওয়া যায়। সিলেটে গড়ে ২৭০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় ১৮০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট। এ কারণে দিনরাত মিলিয়ে জেলাগুলোতে গড়ে ৮-১০ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুতের দেখা পাওয়া যায় না। ২৭ এপ্রিল থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টা বিদ্যুতের দেখা পায়নি সুনামগঞ্জবাসী।
রংপুর বিভাগের আট জেলায় বিদ্যুৎ পাওয়া যায় দিনরাত মিলিয়ে ছয় থেকে আট ঘণ্টা।
চট্টগ্রামে গড়ে ৫৮০ থেকে ৬০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ৩৫০ থেকে ৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলছে। এ কারণে খোদ চট্টগ্রাম শহরে বিদ্যুৎ থাকে না গড়ে আট থেকে ১০ ঘণ্টা।
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায়ও বিদ্যুতের দেখা মেলে মাঝেমধ্যে। তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান এবং ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিদ্যুতের জন্য হাহাকার চলছে।

No comments

Powered by Blogger.