ধর নির্ভয় গান-মানবতাবিরোধী অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য by আলী যাকের

খন এসব অমানুষ আমাদের মানুষকে হত্যার ব্যাপারে সক্রিয় ছিল সেই ১৯৭১-এ, তারা যখন সক্রিয় ছিল আমাদের নারীদের নির্যাতনে, তখন এই স্বচ্ছতার প্রশ্নটি কেন গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের শাসককুল একবারও ভেবে দেখেনি? ভাবতে অবাক লাগে যে, আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে যখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে এই মার্কিন সৈন্যরা হত্যা করেছিল, তখন স্বচ্ছতার প্রশ্ন ছিল কোথায়? তার মানে, এই বিশ্বের বিচার ব্যবস্থা কি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মানদণ্ডে নিয়ন্ত্রিত হবে?


আমি বিভিন্ন সময় একাত্তরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দেখেছি যে, ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ জয়ের পর যখন দেশে ফিরে এলাম, তখন থেকে বিভিন্ন সময়ে আমার এই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কেন যেন এই উপলব্ধি হয়েছিল, যে শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলাম, সেই শত্রুরা তখনও লোকচক্ষুর আড়ালে বসে তাদের ষড়যন্ত্র চালু রেখেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করার জন্য। এ ধরনের একটি শঙ্কা আমার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে অনেকেই একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কলকাতায় যখন ছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, তখন ড. নৃপেন সেন এ কথাটি আমাকে বলেছিলেন, 'স্বাধীনতা অর্জন করেছ বটে, তবে সেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেও না। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছ, তাদের শক্তিকে ক্ষুদ্র করে দেখলে নিতান্ত ভুল হবে। তারা এখনও তোমাদের চোখের আড়ালে বসে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাবে তোমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে। নিদেনপক্ষে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি কনফেডারেশন সৃষ্টি করতে।' ড. নৃপেন সেনের পরিচয় এখানে দিয়ে রাখা ভালো। তিনি বর্তমানে প্রয়াত। তখন কলকাতার পিজি হাসপাতালের প্রখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে তেভাগা আন্দোলন ও নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী বীর কন্যা ইলা মিত্রের ছোট ভাই ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমার দিলি্ল প্রবাসী বন্ধুবান্ধবের মুখে শুনেছি, ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম নাকি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, 'কন্যা, তুমি একটি পাকিস্তান ভেঙেছ বটে কিন্তু দুটি পাকিস্তান বানিয়েছ।' সেই সময় আমি আমার এসব চিন্তা এবং অভিজ্ঞতা যখন অন্য বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বিনিময় করি, তখন তারা এই শঙ্কাকে খুব বেশি একটা গুরুত্ব দেননি। তারা বলেছেন, সদ্য স্বাধীন দেশে এখন আর কোনো বৈরী শক্তি আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে না। আমাদের এখন উচিত হবে গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য কাজ করে যাওয়া।
এভাবে আমরা একটি সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাংলাদেশে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম এবং প্রতিনিয়ত দেখতে পেলাম, লোকচক্ষুর আড়ালে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে পাকিস্তানমনা কতিপয় বৈরী শক্তি আমাদের পুনর্গঠন এবং পুনর্নির্মাণের পথে অগ্রসর হতে দিতে রাজি নয়। অভ্যন্তরীণ এসব শত্রু যখন তৎপর হয়ে উঠছে তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধী যেসব বহিঃশক্তি আছে, তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান সাঙ্গাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটি তলাহীন ঝুড়ি অভিধায় অভিহিত করে এই দেশকে কোনো প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করা থেকে নিজেদের বিরত রাখার কথা ব্যক্ত করেছে। বস্তুতপক্ষে আফগানিস্তানে মৌলবাদী তালেবানের তাণ্ডব শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বামপন্থি্থ রাজনীতির বিরুদ্ধে একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বত্র মৌলবাদীদের মদদ জুগিয়েছে। এমনকি আফগানিস্তানেও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই তালেবান বাহিনী সৃষ্টি করেছিল। এ যে কত ভয়াবহ একটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছিল সে সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধারণাই করতে পারেনি।
এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আবার নতুন করে আজ ভাবতে হচ্ছে, যখন একাত্তরের গণহত্যায় আমাদের দেশজ মৌলবাদী চক্রান্তকারী গোলাম আযম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কারণে আজকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। আমি আমার লেখার শুরুতেই বলেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় অর্জনের পর থেকেই আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার পাকিস্তানপন্থিদের ষড়যন্ত্রের কথা। এই ষড়যন্ত্র যে কত ভয়াবহ ছিল তা আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে, যখন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার হত্যার মাধ্যমেই হত্যাকারীরা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সব মূল্যবোধ ও চেতনাকে উচ্ছেদ করতে একের পর এক বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে।
সম্প্রতি আমাদের বাংলাদেশের এক টেলিভিশন চ্যানেলে গোলাম আযমের একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সেখানে আমাদের স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়ে গেছে_ এ প্রসঙ্গ তুলে মন্তব্য করা হয়, আজ কেন এই বিচারের প্রশ্ন উঠছে এবং যে ব্যক্তি সেই '৭৭ সাল থেকে নির্বিঘ্নে বাংলাদেশে বসবাস করছেন, তাকে কেন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে? প্রথম প্রশ্নটির জবাব অতি সহজ। যে কোনো অন্যায়ের শাস্তি সেই অপরাধের পর কত বছর অতিবাহিত হয়েছে তার দ্বারা নির্ণয় করা হয় না। বরং অপরাধের তীব্রতার দ্বারাই এই অভিযোগটি উত্থাপন করা হয়ে থাকে। আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের যেসব সহযোগী নির্বিচারে ইহুদি হত্যা করেছিল কিংবা কম্বোডিয়ায় খেমার রুজ বাহিনী সে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তার বিচার ওই দেশগুলোতে এখনও চলছে এবং প্রয়োজনে ওইসব অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ডেরও সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অতএব ইতিহাসের বিচারে সময়ের ব্যবধান কোনো বাধা হতে পারে না। গোলাম আযমের ক্ষেত্রে, তিনি যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিলেন, তার যথেষ্ট প্রমাণ এবং সাক্ষী আমাদের বাংলাদেশে মজুদ আছে। তিনি পাকিস্তানিদের যে সরাসরি সহায়তা করেছিলেন তার সবচেয়ে বড় একটি প্রমাণ বাংলাদেশের মুক্তি সমাসন্ন দেখে তিনি পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরবর্তী সামরিক সরকার, যারা পাকিস্তানি মূল্যবোধের পুনর্বাসন চেয়েছিল এই দেশে, তাদের আনুকূল্যে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। এর পরও দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তানপন্থি সাম্প্রদায়িক সামরিক শাসকদের দাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা মানুষ সমূহ বিপদের ভয়ে কিছু বলতে সাহস করেনি। সময়ের আবর্তে ক্রমে গণতন্ত্র যখন মোটামুটি একটি স্থায়ী আসন খুঁজে পায় এই সমাজে, তখন আমাদের মানুষেরা, বিশেষ করে আমাদের তরুণ সম্প্রদায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের যথাযথ বিচারের পক্ষে তাদের সরব এবং ঋজু অবস্থান গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি। সময়ের ব্যবধান যতই হোক, এসব অপরাধীর বিচার সময়েরই দাবি।
অতএব রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা যতই এর বিরোধিতা করুক না কেন, এসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সুবিচার এ দেশের মাটিতে হবেই। প্রসঙ্গত আরও একটা কথা মনে পড়ে গেল, যার উল্লেখ এখানে অনিবার্য বলেই আমি মনে করি। কিছু মানুষ এই বিচারের ব্যাপারে স্বচ্ছতার প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। স্বচ্ছতা অবশ্যই থাকতে হবে। যে কোনো বিচারকে সুষ্ঠু বলে আখ্যায়িত করতে হলে স্বচ্ছতাই হচ্ছে একমাত্র মাপকাঠি। আমি নিশ্চিত যে, আমাদের যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এই বিচারগুলোর জন্য নিয়োজিত আছেন, তারা স্বচ্ছতার বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম থেকেই সচেতন। তবুও একটি প্রশ্ন বারবারই মনে এসে যায়। যখন এসব অমানুষ আমাদের মানুষকে হত্যার ব্যাপারে সক্রিয় ছিল সেই ১৯৭১-এ, তারা যখন সক্রিয় ছিল আমাদের নারীদের নির্যাতনে, তখন এই স্বচ্ছতার প্রশ্নটি কেন গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের শাসককুল একবারও ভেবে দেখেনি? ভাবতে অবাক লাগে যে, আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে যখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে এই মার্কিন সৈন্যরা হত্যা করেছিল, তখন স্বচ্ছতার প্রশ্ন ছিল কোথায়? তার মানে, এই বিশ্বের বিচার ব্যবস্থা কি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মানদণ্ডে নিয়ন্ত্রিত হবে?
আমরা বিশ্বাস করি, মানবতার বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধ কোনোমতেই বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এবং এও বিশ্বাস করি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত সব অপরাধের অপরাধীদের একে একে বিচারের আওতাভুক্ত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা আমাদের সবার কর্তব্য।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.