দারিদ্র্য নির্মূলে দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন চাই by ড. মুহাম্মদ ইউনূস

নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য নির্মূলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আদলে এই ইউনিয়ন গঠন সময়ের দাবি। গতকাল ভারতীয় পার্লামেন্ট লোকসভায় হিরেণ মুখার্জি স্মারক বক্তৃতায় তিনি এ প্রস্তাব করেন। এর আগে এ বক্তৃতা দিয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেলপ্রাপ্ত অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ড. ইউনূসের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নিচে দেয়া হল :
মহাজনের জালে বন্দি
১৯৭৪ সাল। দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ চলছে। ক্লাসরুমে অর্থনীতির পরিশীলিত তত্ত্বগুলোর পাঠ দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। মনোবল চুরমার করে দেয়া ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের সামনে অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলো হঠাত্ বেশ ফাঁপা ঠেকল। বুঝতে বাকি রইল না, ক্যাম্পাস ছাড়তেই হচ্ছে। আমার বাড়ির পাশের জোবরা গ্রামের বিপন্ন মানুষের উপকারী বন্ধু হিসেবে নিজেকে গড়ে তুললাম।
জোবরা গ্রামের দারিদ্র্যের কারণ সম্পর্কে অনেক কিছুই শিখলাম। গ্রামবাসী ও তাদের অসহায়ত্ব অনুধাবনের পর কীভাবে ওদের সহায়তা করা যায়, তা শনাক্তের চেষ্টা করলাম। জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি কীভাবে অল্প অল্প করে জমা রাখতে হয়, তা বোঝাতে চেষ্টা করলাম। মাত্র ৫ টাকার জন্য গ্রামের অসহায় নারীদের মহাজন ও ব্যবসায়ীদের কাছে হাত পাততে হয়েছে জেনে মনে কষ্ট পেলাম। ঋণের শর্ত হচ্ছে, ঋণদাতার নির্ধারিত দরে তার কাছেই পণ্য বিক্রি করতে হবে। আর ৫ টাকার এ ঋণই তাকে কার্যত দাস বানিয়ে ছাড়ল।
টাকা ধারের পরিধি সম্পর্কে মেনে নিয়ে আমি ধার বা ঋণগ্রহীতা গ্রামবাসীর তালিকা বানালাম। ওতে ৪২ জনের নাম পেলাম। তারা মহাজন ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৮৫৬ টাকা ধার নিয়েছে। তাদের মহাজনদের কবল থেকে বাঁচাতে আমি ওই টাকা শোধ করে দিলাম। ঋণমুক্তরা আবেগের সঙ্গে আমাকে বরণ করে নিলেন। মনে মনে ভাবলাম : এ সামান্য কাজ যদি ওদের এতটা খুশি করতে পারে, তাহলে কেন আমি আরও বেশিকিছু করছি না? ওই কাজটিই আমি এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছি।
গ্রামীণ ব্যাংক ভিক্ষুকদেরও ঋণ দেয়
প্রথমেই আমি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অবস্থিত ব্যাংককে এসব দরিদ্রকে ঋণ দেয়ার কথা বোঝাতে চেষ্টা করলাম; কিন্তু ব্যাংক ম্যানেজার ওতে কান দেননি। তার ভাষায়, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার যোগ্যতা দরিদ্রদের নেই—ওরা ঋণযোগ্য নয়।’ কয়েক মাস তাকে বোঝালাম, কিন্তু তার মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে পারিনি। তাই গরিবদের ঋণের জামিনদার হওয়ার প্রস্তাব দিলাম। এবার ব্যাংক তাতে রাজি হলো। ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে জিম্মাদার হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরিবদের দিচ্ছিলাম। এসব ঋণের টাকা কীভাবে সহজে ফেরত দেয়া যায়, তার কিছু টিপস ওদের শিখিয়ে দিলাম। ওসব টিপসে কাজ হলো। গরিবরা প্রতিবারই যথাসময়ে ঋণ শোধ করতে লাগলেন।
আমি বুঝতে পারলাম গরিবদের ধার দিয়ে তা আবার আদায় করে নেয়া যতটা ঝামেলার ভাবতাম, আসলে ঠিক ততটা ঝামেলার নয়; কিন্তু বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর সহায়তায় আমি আমার কর্মসূচি সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে নানা বাধা পেতে লাগলাম। আমি দরিদ্রদের জন্য পৃথক ব্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ১৯৮৩ সালে সফল হলাম। ওটাই এখন গ্রামীণ ব্যাংক নামে পরিচিত।
আজ গ্রামীণ ব্যাংক দেশজুড়ে প্রতিটি গ্রামেই দরিদ্রদের সেবা দিচ্ছে। এটার ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ৮০ লাখ, যার ৯৭ শতাংশই নারী। ঋণগ্রহীতারাই এ ব্যাংকের মালিক। ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের ১৩ জন পরিচালকের মধ্যে ৯ জন পরিচালকই শেয়ারহোল্ডার হিসেবে ঋণগ্রহীতারাই নির্বাচিত করে থাকেন।
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতি মাসে ১০ কোটি ডলারেরও বেশি জামানতহীন ঋণ গড়পড়তা প্রায় ২০০ ডলার হারে দিয়ে থাকে। এ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংক পরিবারের শিশুদের স্কুলে যেতে উত্সাহ দেয়। উচ্চশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে এসব শিশুকে ব্যাংক ঋণও দেয়। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন ৪২ হাজার গ্রামীণ ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। ক্যারিয়ারে কারও কাছে চাকরি চাইবে না, এটাই তাদের আমরা উদ্বুদ্ধ করছি। আমরা তাদের এটাই বোঝাতে চাই, তোমাদের মায়েরাই তো গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক। যে কোনো ঋণ নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যেখানে এ ব্যাংকই তোমাদের দিচ্ছে, সেখানে তোমরা চাকরির জন্য অন্যের দ্বারে দ্বারে কেন ঘুরবে? চাকরিজীবী হওয়ার চেয়ে চাকরিদাতা হওয়া ভালো।
আর্থিক দিক থেকে গ্রামীণ ব্যাংক আত্মনির্ভরশীল। এটার সব তহবিলের উত্স আমানত। অর্ধেকেরও বেশি আমানত আসে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে, যারা প্রতি সপ্তাহে অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে। তাদের সঞ্চিত অর্থ বা আমানতের পরিমাণ ৫০ কোটি ডলারেরও বেশি। ঋণ পরিশোধের হারও অনেক বেশি, প্রায় ৯৮ শতাংশ। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করে, যাদের অন্য ব্যাংকগুলো ঋণযোগ্যই ভাবে না।
গ্রামীণ ব্যাংক ভিক্ষুককেও ঋণ দেয়। এ ঋণ দিয়ে তারা ভিক্ষার পরিবর্তে মানুষের দ্বারে দ্বারে নানা পণ্য বিক্রি করে। ভিক্ষুকরাও এ কাজটি পছন্দ করে। আমাদের কর্মসূচির আওতায় এক লাখের বেশি ভিক্ষুক রয়েছে। চার বছর আগে এ কর্মসূচি চালু হয়। এর মধ্যে ১৮ হাজার ভিক্ষুক ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছে।
দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্র ও জামানতহীন ঋণ প্রদান কর্মসূচি এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, যা মাইক্রো ক্রেডিট বা মাইক্রো ফাইন্যান্স নামে পরিচিত। এখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে গ্রামীণ ব্যাংক ধরনের ব্যাংক রয়েছে। আমরা নিউইয়র্কে ‘গ্রামীণ আমেরিকা’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছি। ওটার শাখা এখন ওমাহা, নেব্রাস্কা ও সানফ্রান্সিসকো পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বের ধনী দেশগুলোতে আধুনিক ব্যাংকের পাশাপাশি দরিদ্রদের সহায়তার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দরকার।
দরিদ্ররা দারিদ্র্য সৃষ্টি করেনি
যখন আমি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করি, তখন প্রায়ই সেই মা-মেয়ে অথবা মা-ছেলের সঙ্গে কথা বলি : যে ক্ষেত্রে মা অশিক্ষিত, কিন্তু মেয়ে অথবা ছেলে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার। একটা কথা মনের দুয়ারে তখন নাড়া দেয়। আর তা হচ্ছে মাটিও হতে পারতেন ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার। কারণ, ছেলে বা মেয়ের মতো তারও সম্ভাবনা ছিল। সমাজ কখনই সুযোগ দেয়নি বলে মাটি ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেননি। এমনকি বর্ণমালা শেখার জন্য তিনি কোনো বিদ্যালয়েও যেতে পারেননি।
দরিদ্রদের পেছনে আপনি যত বেশি সময় ব্যয় করবেন, ততই আপনি এটা নিশ্চিত হতে পারবেন, দারিদ্র্য দরিদ্রদের সৃষ্টি নয়। এটা ওই সমাজ পদ্ধতিরই সৃষ্টি, যা আমরা নিজেরাই নির্মাণ করেছি, এটা ওই প্রতিষ্ঠানেরই তৈরি যা আমরা বানিয়েছি, এটা ওইসব চিন্তাধারাই ফসল, যা আমরাই উদ্ভাবন করেছি। দারিদ্র্য একটি কৃত্রিম সৃষ্টি, ব্যক্তির ওপর বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া। যেহেতু এটার মূল বাইরের, তাই এটা নির্মূল করা সম্ভব।
দারিদ্র্য আমাদেরই তৈরি প্রতিষ্ঠানসমূহের হীনতা থেকে উদ্ভুত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অপূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি। এসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগণকেই ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
যুগের পর যুগ এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান দাবি করে আসছে, দরিদ্রদের ঋণ দেয়া যায় না। আর সবাই এ ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান তাদেরই ঋণ দেয়, যারা বিশ্বটাকে চুষে খান। গ্রামীণ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ নীতিমালাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রমাণ করে দিয়েছে, টেকসই পদ্ধতিতে দরিদ্রদেরও ঋণ দেয়া যায়।
সাম্প্রতিক কালের আর্থিক মন্দায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বস্তাপচা চিন্তাধারার অসারতা অধিকতর প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত নামি-দামি ব্যাংকগুলো তাদের অতিরিক্ত জামানতযুক্ত ঋণ নিয়েও দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত জামানতহীন ঋণ ছাড়াই পরিচালিত মাইক্রো-ক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি আগের চেয়েও শক্তিশালী প্রমাণিত হচ্ছে। এ দৃশ্যমানতা থেকে কি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের চিন্তা কৌশলে পরিবর্তন আনবে? শেষ পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠান তাদের দরজাগুলো দরিদ্রদের জন্য খুলে দেবে?
এ প্রশ্নের ব্যাপারে আমি সত্যি সিরিয়াস। যখন সঙ্কট ঘনীভূত হয়, তখন এটা একটি বিশাল সুযোগ উপহার দিতে পারে। যখন কোনো কিছু ভেঙে পড়ে, তখন পুনঃনির্মাণ, নতুন ছাঁচে তৈরি ও পুনর্বিন্যাসের সুযোগ আসে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্বিন্যাসের সুযোগ আমাদের হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আসুন এগুলোকে আমরা সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করি। কাউকেও আর্থিক সেবা পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। কারণ, দরিদ্রদের আত্মোপলব্ধি সৃষ্টির জন্য আর্থিক সেবা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমি এটা হৃদয়ের সবটুকু চাওয়া-পাওয়া দিয়ে বিশ্বাস করি, মানবাধিকারের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া উচিত।
দারিদ্র্য জাদুঘরের সম্পত্তি
পৃথিবীতে প্রতিটি শিশুই পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়, সে শুধু নিজেরই সেবা করবে না। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করবে। কেউ কেউ তাদের সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পান। আবার কেউ কেউ তাদের জন্মগত অসাধারণ সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পান না। তারা তাদের প্রতিভার বিকাশ ছাড়াই পৃথিবী থেকে চলে যান, আর পৃথিবী তাদের অমূল্য অবদান থেকে বঞ্চিত হয়। গ্রামীণ ব্যাংক আমাকে মানুষের সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারে অমর বিশ্বাস উপহার দিয়েছে। এখন আমি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কষ্টে ভোগার জন্য জন্ম নেয় না। যদি আমরা এটা সম্মিলিতভাবে বিশ্বাস করতে পারি, আমরা এমন একটি পৃথিবী গড়তে সক্ষম যেখানে দারিদ্র্য শুধু জাদুঘরের দর্শনীয় আইটেম হিসেবে কালের সাক্ষী হবে, তাহলে আমরা দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে পারব। এমন একটা সময় আসবে, যখন শিশুরা দারিদ্র্য কি জিনিস, তা দেখতে দারিদ্র্য-জাদুঘরে যাবে। তারা সেখানে এটা দেখে বিস্মিত হবে, মানবতাকে কতই না দুঃখ আর অমর্যাদা ভোগ করতে হয়েছে। তখন তারা এ জাতীয় অমানবিক অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করার জন্য পূর্বসূরীদের দোষ দেবে।
আমার দৃষ্টিতে দরিদ্র লোক বনসাই গাছের মতো। যখন আপনি সুউচ্চ গাছের সেরা বীজ একটি ক্ষুদ্র পাত্রে রোপণ করবেন, তখন আপনি সুউচ্চ গাছের মাত্র কয়েক ইঞ্চি উঁচু একটি রেপ্লিকা পাবেন। আপনি যে বীজ বপন করেছিলেন, তাতে কোনো ত্রুটি ছিল না, শুধু মাটির ভিত্তি ছিল অপরিসর। দরিদ্র মানুষ হচ্ছে বনসাই মানুষ। তাদের বীজে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার ভিত্তি সমাজ তাদের দেয় না। দরিদ্রদের যথাযথভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া আমাদের সবারই দায়িত্ব। দরিদ্ররা যদি তাদের শক্তি ও সৃষ্টিশীলতা বিকাশের সুযোগ পায়, সমাজ থেকে দারিদ্র্য খুব দ্রুত অপসারিত হবে।
একটি ধারণগত মৌলিক ভুল
বর্তমান আর্থিক সঙ্কট প্রসঙ্গে আবার ফিরছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিডিয়া এ সৃষ্টি করেছে যে, যদি আমরা একবার সঙ্কট নির্ধারণ করতে পারি, তাহলে তা আর থাকবে না। আমরা এটা ভুলে গেছি, অর্থনৈতিক সঙ্কট মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ সঙ্কটগুলোর একটি। আমরা বৈশ্বিক খাদ্য সঙ্কট, বিদ্যুত্ সঙ্কট, পরিবেশগত সঙ্কট, স্বাস্থ্যসেবা সঙ্কট এবং দারিদ্র্যের ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগছি। এসব সঙ্কট অর্থনৈতিক সঙ্কটের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, যদিও এসব সঙ্কট তেমন একটা মনোযোগ কাড়তে পারেনি।
উপরন্তু মিডিয়া কাভারেজ এ ধারণাও দিতে পারে, এসব হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্কহীন সঙ্কট, যা দুর্ঘটনাক্রমে পরপর ঘটে যাচ্ছে। এ ধারণা মোটেও সত্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে একই উত্স থেকে এসব সঙ্কটের জন্ম। আর উত্সটি হচ্ছে পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক গঠনের মৌলিক ত্রুটি।
মানব প্রকৃতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার মাঝেই পুঁজিবাদের চলতি তত্ত্বের সবচেয়ে বড় ত্রুটি। পুঁজিবাদের চলতি ব্যাখ্যায় মানুষকে উপস্থাপন করা হয়েছে একমুখী জীব হিসেবে, যার একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে সর্বোত্তম লাভ অর্জনের চেষ্টা করা। এটা মানবতার সবচেয়ে বিকৃত চেহারা। মানুষ টাকা বানানোর রোবট নয়। মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে বহুমুখী জীব। তাদের সুখ শুধু অর্থ উপার্জন থেকে আসে না, নানা উত্স থেকে আসে।
তারপরও অর্থনৈতিক তত্ত্ব এই অনুমানের ভিত্তিতে ব্যবসা-দর্শন দাঁড় করিয়েছে যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক তত্ত্ব উপসংহারে এটাই দাবি করছে, সমাজের জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক ফল তখনই আসবে, যখন প্রতিটি ব্যক্তিকে মুক্তভাবে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ তালাশের সুযোগ দেয়া হবে। মানব চরিত্রের এ ব্যাখ্যা তার রাজনৈতিক, সামাজিক, আবেগগত, আধ্যাত্মিক ও পরিবেশগতসহ জীবনের অন্য সব ভূমিকাকে অস্বীকার করে। সন্দেহ নেই, মানুষ স্বার্থপর, কিন্তু তারা স্বার্থহীনও বটে। অথচ অর্থনীতিতে মানুষের এ স্বার্থহীন দিকটির কোনো ভূমিকা নেই। মানুষের প্রকৃতির এ বিকৃত উপস্থাপনাই আমাদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারাকে অপূর্ণাঙ্গ ও অযথার্থ বানিয়েছে। আর সময়ের ব্যবধানে তা-ই অর্থনৈতিক সঙ্কটকে করেছে শতগুণে জটিল, যা আজ আমরা ভোগ করছি।
আমরা যদি আমাদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার তাত্ত্বিক কাঠামোর এ ত্রুটি একবার শনাক্ত করে ফেলতে পারি, তাহলে সমাধানও অবশ্যম্ভাবী। তখন আমরা সহজেই অর্থনৈতিক তত্ত্বের একমুখী মানুষটিকে বহুমুখী মানুষ বানিয়ে ফেলতে পারব; যে মানুষটির একই সময়ে স্বার্থপর ও স্বার্থহীন আগ্রহ থাকবে।
আমাদের বাণিজ্য বিশ্বের ছবি পাল্টাতে শুরু করেছে। আমরা এখন দু’ধরনের ব্যবসা দেখতে পাচ্ছি। এক ধরনের ব্যবসা শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্য, বাকি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যদের সহায়তা প্রদান। এক ধরনের ব্যবসায়ের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যদের কথা বিবেচনায় না এনে শুধু মালিকের সর্বোচ্চ লাভের চিন্তা, বাকি ধরনের ব্যবসায়ের টার্গেট হচ্ছে সদস্যদের কল্যাণের জন্য সবকিছু করা, এখানের মালিকের লাভের জন্য কিছু করা হয় না। হ্যাঁ এ ধরনের ব্যবসায়ে মালিক মানবতার সেবার আনন্দ ছাড়া আর কিছুই পান না।
দ্বিতীয় ধরনের ব্যবসা মানব প্রকৃতির স্বার্থশূন্য দিকটি কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এটার নাম দিয়েছি ‘সামাজিক ব্যবসা’। আমাদের অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলোতে এ ব্যবসার কথা নেই।
সামাজিক ব্যবসা
সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে এমন ধরনের ব্যবসা যেখানে একজন বিনিয়োগকারী নিজের ব্যক্তিগত লাভ ছাড়াই বিনিয়োগ করেন। আবার এটাও সত্য, সামাজিক ব্যবসা নিজের খরচেই পর্যাপ্ত আয় করতে পারে। এ ব্যবসাকে সম্প্রসারণ বা সমাজের কল্যাণ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য এখানে ব্যবসায়ের মুনাফাও বিনিয়োগ করা হয়। সামাজিক ব্যবসা লোকসানহীন এমন কোম্পানি যাতে লাভ বণ্টন না করে একটি সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে উত্সর্গীকৃত।
জাগতিক বিশ্বে স্বার্থহীন লক্ষ্যস্থির করে কেউ কি সামাজিক ব্যবসা চালু করতে আগ্রহী হবেন? সামাজিক ব্যবসায়ের টাকাই বা কোত্থেকে আসবে? মানব প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে আমি এটাই বুঝতে পেরেছি, অনেক মানুষ স্বার্থহীন সামাজিক ব্যবসা চালু করে তৃপ্তি পাবেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যে সামাজিক ব্যবসা শুরু করেছেন। আমি তাদের দু’একজন সম্পর্কে পরে ধারণা দেব।
সামাজিক ব্যবসায়ের তহবিল গঠনের অনেক উত্স আছে। তবে অনুদান এমন একটি উত্স যা দিয়ে সহজেই সামাজিক ব্যবসায়ের তহবিল গঠন করা যায়। বিষয়টি নানা প্রশ্ন তৈরিও করতে পারে। দাতব্য কর্মসূচির একটি সমস্যা হচ্ছে, এটা সব সময় অনুদানের উপর নির্ভরশীল। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। ভালো কাজ করতে গিয়ে অনুদানের টাকা খরচ হয়ে যায়, সে টাকা আর ফিরে আসে না।

No comments

Powered by Blogger.