আজ বিএনপির কাউন্সিলঃ সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার হিসাব-নিকাশ by ডক্টর নয়ন বাঙ্গালী

কাউন্সিলের ঠিক হুবহু বাংলা জানা নেই, তবে তার সিনোনিমে যে শব্দগুলো আছে সেগুলো হচ্ছে—কংগ্রেস, অ্যাসেম্বলি, কনভেনশন ইত্যাদি। তবে আমরা রাজনৈতিকভাবে সম্মেলন শব্দটি খুব বেশি মনে-প্রাণে আত্মস্থ করেছি। দীর্ঘ ১৬ বছর পর আজ বিএনপির ৫ম জাতীয় কাউন্সিল।
এরই মধ্যে ২৪টি জেলায় কম-বেশি গণ্ডগোল হলেও একক কমিটি ঘোষণার মাধ্যমে সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। অন্য ২৪টিতে গণ্ডগোল হয়েছে, দুটি করে কমিটির নাম ঘোষণা হয়েছে, সম্মেলনও সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি ২৪টিতে সম্মেলনই হয়নি—এতবড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে তৃণমূল নেতাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সম্মেলন করা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্য দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়। দল কি পেল আর কি হারাল তার বিশ্লেষণটি আমি করার আগে সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি রাজনৈতিক দল, বিদেশি প্রভুদের চর/অনুচর, দেশের সাধারণ মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কী হতে যাচ্ছে আজকের ৮ তারিখে। আবার তদ্রূপ বিএনপিও প্রতি মুহূর্তে জোর গলায় বলেছে ৮ তারিখই সম্মেলন হতে হবে—কোনো ষড়যন্ত্রই মেনে নেব না। আসলেই কি ষড়যন্ত্র চলছিল? বুঝি না। যেমনটি বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় যেদিন হবে সেদিন ঢাকা শহরকে আতঙ্কে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল সরকার; তাদের বক্তব্য ছিল কেউই এ রায়কে ঠেকাতে পারবে না। আসলে কি আদৌ কেউ এ রায় ঠেকাতে চেয়েছিল, না সাধারণ জনগণ, না দেশের বিরোধী দলগুলো। এটা ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি।

তবে সবার ওপরে যে কথাটি সত্য তা হলো, আজকের সম্মেলনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ব্যতিক্রমী ও উল্লেখযোগ্য অধ্যায় সূচিত হচ্ছে, যা শুধু বিএনপির জন্যই নয়, সব রাজনৈতিক দলের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যারা গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়, মানুষকে ধোঁকা দেয় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য; কিন্তু নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও তার সুস্থ প্রতিযোগিতা করে না, এ দৃষ্টান্ত তাদের হয়তো বদলাতে পারে। ফলে সে বিচারে একধাপ এগিয়ে গেল বিএনপি। কথায় আছে Charity begins at home বিএনপিও তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশেই। নিদেনপক্ষে একটা দল একটা বড় কিছুর শুভসূচনা তো করে দিল। আগামীকাল সকালে প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলো গরম হয়ে উঠবে। প্রশংসা ও সমালোচনার ঢেউ উঠবে আজকের এ সম্মেলনকে ঘিরে। যাক সে আলোচনায় এখন নাইবা গেলাম। কিন্তু এ কথা তো ঠিক, আমরা সবাই পরিবর্তন চাই—সঠিক অর্থে পরিবর্তন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, গণতন্ত্রের কার্যকারিতার পূর্বশর্ত হলো আইনের শাসনের যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও বাস্তবিক প্রয়োগ এবং জনগণের সামগ্রিক যোগ্যতাসম্পন্ন অবস্থা—অতএব এই দুই ব্যবস্থা ও অবস্থার একটিও দুর্বল হলে অন্যটি যতই কার্যকর হোক না কেন প্রকৃত ও পূর্ণ গণতন্ত্রের নির্যাস পাওয়া দুষ্কর। দলের গঠনতন্ত্রে ও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় আইনের ব্যাখ্যা স্পষ্ট, কিন্তু তার প্রয়োগ কী যথাযথভাবে কোনো দলে আছে? কারণ গণতন্ত্র মাঠপর্যায়ে নিঃসন্দেহে সংঘাতের। বিএনপি যে সাহস দেখিয়েছে তার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষে সময় লাগবে আরও ১ দশক। প্রক্রিয়াগত ত্রুটি লালন করে আমরা গণতন্ত্রের কথা যতই উচ্চস্বরে আওড়াই, দলীয় স্বার্থ রক্ষায় আমরা ততটাই অগণতান্ত্রিক। তাই ক্ষমতা বদলালেও বদলায় না রাজনীতির গুণগতমান। ক্ষমতায় থাকলে করা হয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকার দাবি, আর না থাকলে করা হয় গণতন্ত্র নস্যাতের অভিযোগ। নেতাদের ভোটে নির্বাচিত নেতারা পরবর্তী সময়ে জনগণের ভোটে জননেতা হন। তাহলে প্রথম ধাপই হচ্ছে সেই ব্যক্তির জন্য দলের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব অর্জন করা—তবেই সে হবে রাজনীতিক। রাজনীতিক বলতে জাতি সেবক বোঝায়, যার জন্য সততা, নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা ও প্রজ্ঞা অপরিহার্য। স্কটিস লেখক রবার্ট স্টিভেনসন সমালোচনার্থের লিখেছেন : ‘Politics is perhaps the only profession for which no preparation is thought necessary’. বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘রাজনীতি হয়তো একমাত্র পেশা, যার জন্য কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন বিবেচ্য হয় না’—আর তাই যদি সত্য হয় গণতন্ত্র কতটা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে পারে। রাজনীতিতে স্বার্থের শ্রেণী, শোষণের কালবৈশাখী ঝড়, কর্তব্যহীনতার সুনামি, অথর্বদের প্লাবন, তাঁবেদার ও চাটুকারিতার মহামারি আর নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ যখন বিরাজমান তখন গণতন্ত্রের এ তন্ত্রে কার্যত রাজনীতিকরা নিজেরাই নিজেদের দ্বারা প্রতারিত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। রাজনীতির কক্ষচ্যুতি ঘটায় নীতি আদর্শের রাজনীতিকরা উল্কার মতো ঝরে পড়তে শুরু করেছেন, যে জন্য আমরাও দায়ী। বিএনপির রাজনীতিতে এখন চলছে গণতন্ত্রের গিনিপিগ টেস্ট, যার ফলে ফল ভোগ করবে অন্য সব দল। কিন্তু এই অ্যাসিড টেস্টের অন্যতম দলের তৃণমূলে ঘটে যাওয়া শত বিভেদ বিদ্বেষকে প্রশমিত করতে কতদিন সময় নেবে এখন তা বলা যাবে না। তবে সাবাস বিএনপি—এতটা সাহস দেখানোর জন্য। যদিও আজ কাউন্সিলরদের গুরুত্ব অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ আজ ভোটাভুটির কোনো সুযোগ নেই। ভোট না দিলেও কাউন্সিলে কাউন্সিলররা থাকবেন আর থাকবেন হাজার হাজার ডেলিগেট, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে আগত অতিথি, বিদেশি কূটনীতিক, দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা। এত আলোর ঝলক থাকার মূল কারণই হচ্ছে বিএনপি দেশের অন্যতম সর্ববৃহত্ দল।
আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে, যদিও তারা ক্ষমতায় ছিল এবং অনেক বড়ভাবে করার সুযোগও ছিল; কিন্তু ঝামেলা এড়াতে নিরাপদ থাকার স্বার্থে, প্রকাশ পেয়ে যায় সেই ভয়ে দলের প্রকৃত করুণ অবস্থা মির্জা আব্বাসের ভাষায় কসমেটিক স্টাইলে সম্পন্ন করেছে, সে বিচার করলে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপির সম্মেলনটি অনেক বেশি authentic ও festive, তা তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত যতোই সমস্যা পোহানো হোক না কেন। গবেষকরা মাঝেমধ্যে অভিযোগ করে থাকেন, বিএনপি যতটা না প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল, তার চেয়ে বেশি সব মতের বিবিধ রূপের আশ্রয়স্থল তথা বটবৃক্ষ। বিভিন্ন মতের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মাথাগোঁজার ঠাঁই। এক রাজনৈতিক ছাতা নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ ও গম্ভীর মনে বেগম খালেদা জিয়া; যেখানে নেই মিথ্যা লোক দেখানো স্বামী হারানোর মায়া কান্না, নেই সন্তানদের আধমরা করে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটানোর ক্ষোভ, নেই কোনো বিচারের নামে প্রতিশোধের জ্বালা কিংবা অতি উচ্চাবিলাসী মন নিয়ে দেশ-বিদেশে উড়ে বেড়ানোর স্বাদ। কিছুদিন আগে তার একটা article দেখলাম ‘ডানপন্থীদের বামে আর বামপন্থীদের ডানে’। সত্যিই বিএনপিতে ন্যাপ ভাসানী, মুসলিম লীগ, জাসদ, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টি—সব দল থেকে আসা, দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে; ডান-বাম, সাদা-কালো, ধর্ম-বর্ণ কোনো বিভেদ-পার্থক্য নেই দলনেতার কাছে। অতএব এ দল সর্ববৃহত্ হবে না তো কোন দল হবে। বাংলাদেশ এগুবে রাজনীতিতে এ সম্মেলনের থিম সংও স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে—নানা মানুষ, নানা পথ, দেশগড়ার ঐক্যমত।
বিএনপির জাতীয় সম্মেলনে শুধু চেয়ারম্যান নির্বাচন হবে, যদিও এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এককভাবে নির্বাচিত হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া এবং পরবর্তী সময়ে চেয়ারম্যান তার পদাধিকার বলে মহাসচিব মনোনয়ন দেবেন। বিচারপতি টিএইচ খান প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য আরএ গনি রিটার্নিং অফিসার তাদের জীবনের সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করলেন। বেগম খালেদা জিয়াকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করার সুযোগ—এ যেন বিরাট প্রাপ্তি।
১/১১-এর পর বিএনপির ওপর স্টিমরোলার চলার পরও যে এমনিভাবে এ দল ঘুরে দাঁড়াবে, তা স্বপ্নের মতো মনে হয়। রাজনীতির দৌড়ে যেন ভাগ্যটা ওদের প্রথম হওয়ার জন্য তৈরি করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দল আওয়ামী লীগ—এত ঐতিহ্যময় ইতিহাস ও বড়মাপের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যুক্ত যে দল, সে দলের কথা ভুলে যাই বিএনপির জনসমর্থন ও তৃণমূলে জনস্রোত দেখলে। আগামী বিএনপির ধারক তারেক রহমানের সুস্থ দেহকে যেমনিভাবে কারাগারে নির্যাতন করে অর্ধপঙ্গু করা হয়েছে—যার নজির আর নেই, আবার সংস্কারের নামে যে বুলডোজার চালানো হয়েছে, তাতে দলটি ভেঙে খান খান হয়ে যাওয়ার কথা, সর্বোপরি নির্বাচনের মাধ্যমে দলের অস্তিত্ববিলীন করার ভয়াবহ ষড়যন্ত্রও দমিয়ে রাখতে পারল না বিএনপি নামের বটগাছটিকে।
বিএনপি নেতাদের অনেক গুণ ও যোগ্যতা দলটিকে এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে তা কিন্তু নয়। এ দল আপনা-আপনিই বড় হবার। জিয়াউর রহমানের মতো উত্তম পুরুষের প্রতিচ্ছবি দলের প্রতিটি রক্ত কণিকায়, যার আধুনিক ভাবধারা যেন ২০ বছর আগেই ৫০ বছর হয়েছে তাও কিন্তু নয়। রাজনীতির প্যাটার্ন সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সাদামাটা নির্লোভ ব্যক্তিত্ব, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাজসজ্জা—যেন মনে হয় এখনও কোনো তরুণ নেতা জিয়ার মতো স্মার্টভাবে দাঁড়ানো হয়তো শেখেনি। মুজিব কোটের সেই পুরনো সংস্কার ভেঙে দিয়েছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, তারপর এলেন বেগম খালেদা জিয়া যেন সারা দেশে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিল তার ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য, আপসহীন উদ্দীপ্ততায় যেন জেগে উঠল গোটা জাতি। ধন্যবাদ শহীদ জিয়া, ধন্যবাদ বেগম খালেদা জিয়া—সফল হোক আজকের সম্মেলন।

No comments

Powered by Blogger.