কাঁচা পাট রফতানিতে নিষেধাজ্ঞাঃ ক্ষতির দায়িত্ব কে নেবে?


নির্বাচিত সরকার সাধারণত গণতান্ত্রিক হয়। সব মহলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সাধারণের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়াই তার বৈশিষ্ট্য। তবে সব সময়ই এমনটা হয় না। কখনও কখনও মহলবিশেষের স্বার্থই প্রাধান্য পায়। আওয়ামী মহাজোট সরকারের প্রথম বছর পূর্তির আগেই সর্বত্র গোষ্ঠী বা দলপ্রীতি এমন হয়ে উঠেছে যে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে।
বুধবার সকালে খুলনার দৌলতপুরে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনেরও (বিজেএ) সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করেছে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। গতকাল আমার দেশ-এ প্রকাশিত খুলনা প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সোমবার বেলা ৩টায় হঠাত্ করে সরকার কাঁচা পাট রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এভাবে একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে অবরোধকারীরা পাটমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেছেন।

বিজেএ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ বেল পাট উত্পাদন হয়। অন্যদিকে ২১টি রাষ্টায়ত্তসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকলে প্রায় ৩২ লাখ বেল কাঁচা পাট ব্যবহৃত হয়। বাদবাকি পাট রফতানি করে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এখন চট্টগ্রাম ও বেনাপোল বন্দর দিয়ে রফতানির জন্য ৮শ’ কোটি টাকার ৯ লাখ বেল পাট মজুত রয়েছে। মংলা বন্দরে দুটি জাহাজে ব্রাজিল ও পাকিস্তানে রফতানির জন্য পাট লোড করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় হঠাত্ করে রফতানি বন্ধের আদেশে সংশ্লিষ্ট সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। পাট চাষী, ফড়িয়া, বেপারি, সাধারণ ব্যবসায়ী ও রফতানিকারক মিলে ১০ লাখেরও বেশি পরিবারের কোটিখানেক মানুষের জীবনে সৃষ্টি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। খুলনা ও নারায়ণগঞ্জের ৫০টি জুট প্রেসে কর্মরত লক্ষাধিক শ্রমিকের রুটি-রুজি পড়েছে হুমকির মুখে।
সম্ভবত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে কাঁচা পাটের সরবরাহ নিশ্চিত করতেই সরকার পাট রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এ ধরনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাট ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আটকে আছে। প্রয়োজনীয় অর্থাভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল কর্তৃপক্ষ বিগত দিনে কেনা পাটের দাম পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা নতুন করে সেখানে পাট সরবরাহে আগ্রহী হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা বৈধভাবে পাট রফতানি ঠেকাতে পারলেও এর ফলে পাটের চোরাচালান বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ১৯৮৪ সালেও এরশাদ সরকার একই পদক্ষেপ নিয়েছিল। তখন রফতানিকারকদের ৫শ’ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি দেশে পাটের দাম পড়ে গিয়েছিল, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছিল। দাম না পেয়ে কৃষক পাটে আগুন দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। এ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সরকারি সিদ্ধান্ত ভুল উল্লেখ করা হয়। তারপর আবার পাট রফতানির আদেশ জারি করা হয়েছিল।
মহাজোট সরকারের পাটমন্ত্রীর জানা না থাকলেও এসব ঘটনা পাট মন্ত্রণালয়ের অজানা থাকার কথা নয়। তার পরও হঠাত্ করে পাট রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির কারণ বোঝা দুষ্কর। পাট সেক্টরে জড়িতদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেননি কর্তাব্যক্তিরা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—কার স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে? এমনিতেই দেশের অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত। বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। স্বাভাবিক ব্যবসায়-বাণিজ্যের সমস্যা কাটছে না। এ অবস্থায় পাট রফতানির বিপর্যয় ডেকে আনাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ বলা যাবে? এর ফলে সবাইকে যে মাশুল গুনতে হবে তার দায়তায়িত্ব কে নেবে? বিষয়টা দ্রুত পুনর্বিবেচনা করা না হলে বাংলাদেশ পাটের আন্তর্জাতিক বাজারে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সেটা সরকারের জন্য মোটেই সুখকর হবে না।

No comments

Powered by Blogger.