র‌্যাবের ডগ স্কোয়াডে সরাইলের হাউন্ড কুকুর

জাবেদ রহিম বিজন/মাহবুব খান বাবুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে: র‌্যাব-এর ডগ স্কোয়াডে যোগ হচ্ছে সরাইলের বিখ্যাত হাউন্ড কুকুর। জার্মান শেফার্ড ও  ল্যাবরেটর প্রজাতির কুকুরের সঙ্গে এগুলোকেও অপরাধ নির্মূলে কাজে লাগানো হবে  পৃষ্ঠা ৮ কলাম ৫
। সহিংসতা প্রতিরোধ ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরার কাজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে র‌্যাব সংগ্রহ করেছে হাউন্ড কুকুরের ৪টি বাচ্চা। এদিকে সরকারিভাবেও বিলুপ্তপ্রায় সরাইলের হাউন্ড কুকুর রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কুকুর সংরক্ষণাগার কেন্দ্রটি আবার চালু করা এবং কুকুরের বর্তমান হাল অবস্থা জানিয়ে ইতিমধ্যে উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ  ঢাকায় প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। আশির দশক পর্যন্ত সরাইল সমৃদ্ধ ছিল হাউন্ড কুকুরে। বিখ্যাত এ কুকুর পরিণত হয়েছিল এখানকার ঐতিহ্যে। কুকুরের কারণে সরাইলের নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ-বিদেশে। ওই সময়টাতে নিয়মিত সরাইলে হাউন্ড কুকুরের প্রদর্শনী হতো। যার কুকুর সবদিক দিয়ে ভাল তাকে দেয়া হতো পুরস্কার। ছিল কুকুর সংরক্ষণাগার কেন্দ্র। বাড়ি বাড়ি ছিল এই কুকুর। শুধু শখে নয়, নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই গৃহস্থরা পুষতেন এই কুকুর। বলা হয়, যে বাড়িতে এ কুকুর ছিল সে বাড়িতে রাতে তো বটেই, দিনের বেলায়ও অপরিচিত কোন লোকের ঢোকার সাধ্যি ছিল না। মোটকথা, একটি কুকুর নিজ গৃহস্থের বাড়ি যেমন বিশ্বস্ততার সঙ্গে পাহারা দিয়েছে তেমনি পুরো পাড়া-মহল্লাবাসীকেই রেখেছে নিরাপদ। এ অবস্থা এখন আর নেই। হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতে দেখা মিলে কুকুরের। তাও আসল নয়। শুধু কুকুরের সাহসিকতার গল্পই ফিরে মানুষের মুখে মুখে। সরাইলের জমিদার দেওয়ান মোস্তফা আলীই প্রথম এ জাতের কুকুর সরাইলে নিয়ে আসেন। এদের আদিবাস ইউরোপে। ইতিহাসে বলা হয়, ২ শতাধিক বছর আগে তদানিন্তন সরাইল পরগনার জমিদার দেওয়ান মন্নর আলী এক আফগান সওদাগর মতান্তরে ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে হাতীর বিনিমেয় বিশেষ জাতের এক মাদী কুকুর সংগ্রহ করেন। একদিন এ জমিদার জঙ্গলে শিকারে গেলে সঙ্গে থাকা মাদী কুকুরটি হারিয়ে যায়। ৬ মাস পর এটি গর্ভবস্থায় ফিরে আসে। বাচ্চা প্রসব করার পর দেখা যায় এগুলোর আকার আকৃতি সাধারণ কুকুরের চেয়ে ভিন্নতর। এগুলো বড় হয়ে বাঘের বাচ্চার মতো আচরণ করতে শুরু করলে সবাই ধারণা করেন, মাদী কুকুরটির সঙ্গে জঙ্গলে কোন বাঘের মিলন ঘটেছিল। সরাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মজিবুর রহমান জানান, এই কুকুরগুলোর লেজ থাকে নিচের দিকে। এগুলো লম্বাটে এবং চিকন হয়। পায়ের থাবাগুলো বাঘের মতো। মুখ লম্বাটে ধরনের হয় এবং খুব দৌড়াতে পারে। ঘণ্টায় একটি কুকুর ৬৭ কিলোমিটার দৌড়াতে পারে বলে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আর জানান, দেশীয় কুকুরের সঙ্গে মিশ্রণে এর অরিজিনাল জাতটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তারপরও বর্তমানে যেগুলো আছে সেগুলো অন্যান্য কুকুরের চেয়ে ভাল। সরজমিন কুকুর পালনকারীদের সঙ্গে কথা বলে বিশেষ জাতের এ কুকুর বিলুপ্তির নানা কারণ জানা গেছে। একজন মানুষের পেছনে যে খরচ হয় তার চেয়েও বেশি খরচ হয় একটি হাউন্ড কুকুর পালনে। সপ্তাহে ২/৩ দিন মাংস খেতে দিতে হয়। আর জন্মের পর ৬ মাস পর্যন্ত খাওয়াতে হয় দুধ। এ খরচ জোগানের সঙ্গতি না থাকা, যথাযথ পরিচর্যার অভাব এবং চিকিৎসা অপ্রতুলতা কুকুর বিলুপ্ত হওয়ার মুখ্য কারণ বলে জানান সৌখিন কুকুর পালনকারী  শরীফ আবদুল্লাহ রানা ও তপন লাল রবি দাশ। সরাইলের নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চৌরাগোদা গ্রামের তপনরা তিন পুরুষ ধরেই কুকুর লালন পালন আর বিক্রির কাজ করছেন। সরাইল হাউন্ড কুকুরের ঠিকানা বলতে এখন তপনের বাড়ি। কেউ কুকুর দেখতে চাইলে বা কিনতে চাইলে তপনদের বাড়িতেই নিয়ে আসা হয়। র‌্যাব তপনের কাছ থেকেই কিনেছে ৪টি বাচ্চা। তার মতে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই কুকুর বিলুপ্তির প্রধান কারণ। তপন বলেন, আমরা ১০/১২টি কুকুর পালি। কুকুরের বাচ্চা বেচা বিক্রি করি। অনেক সময় বাচ্চা টিকেও না। ৫/৬টা বাচ্চা দিলে ২/৩টা টিকে। মোটকথা ধারদেনা করেই আমাদের এগুলো লালন পালন করতে হয়। কেউ সাহায্য করে না।
১৯৮৩ সালে সরকারিভাবে হাউন্ড কুকুর রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তখন ৩২ হাজার টাকা ব্যয়ে উপজেলা পরিষদের কাছে ৪ কক্ষবিশিষ্ট কুকুর সংরক্ষণাগার কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নানা অনিয়ম দুর্নীতির কারণে ২/৩ বছরের মধ্যে এটি বন্ধ হয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। বর্তমানে এই কেন্দ্রটি ব্যবহৃত হচ্ছে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিস হিসেবে। বেশ কয়েক বছর আগে ড. জিয়াউদ্দিন ঠাকুর নামে এখানকার এক সৌখিন কুকুর পালনকারী স্থানীয় বিসিক শিল্প নগরীতে একটি প্লট নিয়ে একটি খামার করেছিলেন। কিন্তু তার এ চেষ্টাও  সফল হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে, কুকুরগুলো রক্ষায় আবারও সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি র‌্যাবও বিশেষ জাতের এ কুকুরের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
আবার কুকুর রক্ষার চেষ্টা: ২৩/২৪ বছর পর বিশেষ জাতের এ কুকুর রক্ষায় নেয়া হচ্ছে আবার সরকারি উদ্যোগ। স্থানীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা ২০০৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সরাইলের হাউন্ড কুকুর রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য একটি ডিও লেটার দেন। এতে তিনি বলেন, প্রচণ্ড রকম হিংস্র, সাহসী ও প্রভুভক্ত হওয়ায় অল্প দিনের মধ্যে এ কুকুরের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ-বিদেশে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুকুরের এ প্রজাতিটিকে রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর সেগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৮৩ সালে জাতীয় পার্টির সরকারের সময় এ কুকুর রক্ষায় সরকারিভাবে একটি খামার করা হয়। ১৯৮৮ সালে অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ডিও লেটারে এ খামারটি আবার চালু করার দাবি জানান। সংসদ সদস্য এটি সংসদেও উত্থাপন করেন। উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। সরাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মজিবুর রহমান জানান, সংসদ সদস্যের ডিও লেটারের প্রেক্ষিতেই মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে খামারটির বর্তমান অবস্থা এবং এতে ক’টি কুকুর আছে তা জানতে চাওয়া হয়। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এ বিষয়ে একটি জরিপ করি এবং খামারের জায়গাটির বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে ঢাকায় প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেই।
র‌্যাবের খাঁচায় হাউন্ড কুকুর: সরাইলের কুকুরের বিশেষ গুণ আগ্রহী করে তুলেছে র‌্যাবকে। হাউন্ড কুকুরের ৪টি বাচ্চা এখন বেড়ে উঠছে র‌্যাবের খাঁচায়। জানা গেছে, এগুলোকে প্রশিক্ষিত করে লাগানো হবে অপরাধ দমন কাজে। এই কুকুর দিয়েই গঠন করা হবে র‌্যাবের দাঙ্গা দমন ইউনিট। বর্তমানে র‌্যাবের ডগ স্কোয়াডে জার্মান শেফার্ড ও ল্যাবরেটর প্রজাতির ৭৪টি কুকুর রয়েছে বলে জানা যায়। এই কুকুরগুলো বিস্ফোরক, অস্ত্র ও মাদক বিষয়ে প্রশিক্ষিত। এর সঙ্গে প্রাথমিকভাবে সরাইলের আরও ১২টি কুকুর যোগ করা হবে। মাস দেড়েক আগে নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চৌরাগোদা গ্রামের তপন লাল রবি দাসের বাড়ি থেকে ৩০ হাজার টাকায় ৪টি বাচ্চা কিনে নেয় র‌্যাব। এ ব্যাপারে র‌্যাব-৯ কর্মকর্তা মেজর মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা সরাইল থেকে কুকুরগুলো সংগ্রহ করে র‌্যাব হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিয়েছি। এগুলো র‌্যাব ডগ স্কোয়াডে সংযোজন করা হবে। আমরা আরও হাউন্ড কুকুরের পুরুষ বাচ্চা সংগ্রহ করবো।

No comments

Powered by Blogger.