কান্নার প্রকাশে সংকোচ, দন্তের বিকাশে উল্লাস by রণজিৎ বিশ্বাস

:পনি বেশ জটিল জটিল কথা বলেন। : দুটো কথা আছে। হালের তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিজের বয়স কমিয়ে নিতে গিয়ে আমার একটা উপকার হয়েছে। আমি ওদের ভাষা, কিছু কিছু শব্দ ও এক্সপ্রেশনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। কিছু আপনি চট করে বুঝে নিতে পারবেন, কিছু ধাক্কা খাবেন। সে ধাক্কা আনন্দেরও হতে পারে!


যেমন_ আপনি যদি বলেন, দেব তোমাকে এ কাজ! তোমার খুব কষ্ট হবে; ওরা অনেকেই বলবে_ না, কোনো সমস্যা নেই। ওদের আপনি বলতে শুনবেন_ তুই একটা মারাত্মক ভালো মানুষ, তোকে আজ ভয়াবহ সুন্দর দেখাচ্ছে, তোদের বাড়ির খাবারটা আজ জটিল হয়েছে (খুব ভালো অর্থে)। এ ধরনের ভোকেবুলারির সঙ্গে আপনি সম্ভবত পরিচিত নন।
বুঝতে পারছি, আমার কথাকে আপনি ভালো অর্থে জটিল বলেননি। যে অর্থে আপনি বলেছেন, তা আমি বুঝেছি এবং তা আমি মানি না। জটিল কথা আমি বলি না, কুটিল বা আবিল বুদ্ধির চর্চাও আমি করি না। আমি বড় সরল সোজা, বড় প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল কথা বলার চেষ্টা করি। পাখির গান পাখি গেয়ে যাওয়ার মতো, তাতে কারও অলস নিদ্রা টুটল কি টুটল না তার কোনো ভ্রূক্ষেপ-পরোয়া না করার মতো।
আরেকটা কথা আপনাকে বলে রাখি_ সংসারে একজনের কাছে যা জটিল; আরেকজনের কাছে তা অন্যরকমও মনে হতে পারে। আমার এক বন্ধু আছে প্রজন্মান্তরের, যার মতো বন্ধু নিজের প্রজন্মেও আমি তেমন খুঁজে পাই না, আমাকে আবিষ্কার করে নেওয়ার পর সে বলেছে_ আপনার জটিলতা আর দুর্বোধ্যতাটাই তো আমার ভালো লাগে।
মনে করুন, আপনি মানবতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেন। দেখবেন, এই কাজটি যত পবিত্রই হোক, এটি দিয়ে আপনি শত্রুও তৈরি করছেন, মিত্রও। কারণ এই কথাগুলোই মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি হওয়ার পরও ভয়াবহ অকৃতজ্ঞ কারও কারও বিপক্ষে যাচ্ছে। আপনি নিরপেক্ষ থাকতে পারছেন না! বুঝতে পাচ্ছেন তো আমার কথা?
: আরও বোঝানোর চেষ্টা করুন।
: সে চেষ্টা যদি করি, তবে সবার আগে বলব_ নিরপেক্ষতাও এক ধরনের পক্ষাবলম্বন। ছাত্রজীবনে একটা সুন্দর পর্যবেক্ষণের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিলাম। Nobody is neutral. Everybody is a Partisan- either for, or against. .
: সে কত বছর আগে?
: বয়স জানার টেকনিক? তাহলে বলব না। আমার মেসেজটা আপনি নিন। আমরা আসলে কিছু কিছু মৌলিক বিষয়েও এত বেশি বিভক্ত যে, তা নিয়ে কোনো যৌক্তিক উচ্চারণও রহিম-করিম যদু-মধু সবাই একভাবে নেয় না। তা রহিমের পক্ষে গেলেও করিমের বিপক্ষে যাচ্ছে; যদু তা পছন্দ করলেও মধু মেনে নিতে পারছে না।
: তেমন কী কথা আছে আমাদের সমাজে?
: কী কথা নয়, বলুন কী কী কথা।
: এই কথাগুলো বলে কি আপনি শত্রুমিত্রের ঘরঘরানাকে বড়ছোট করেছেন?
: তেমন বললে বলতে পারেন। দুটির যোগফল যদি এক বা একশ' হয়, একটি বড় হলে অন্যটি তো ছোট হবেই! তবে আপনার ভাবনায় আরেকটা জিনিস আমি দিয়ে রাখি, মিত্রের বৃদ্ধিটা টের পাওয়া যায় না, শত্রুরটি পাওয়া যায়।
: এর কারণ কী?
: আমি দুটো খুঁজে পেয়েছি। বিপদের সময় মিত্ররা কাঁদে, শত্রুরা হাসে। মানুষ গোপনে কাঁদে কিন্তু প্রকাশ্যে হাসে। কান্নার প্রকাশে মানুষের সংকোচ আছে, কিন্তু দন্তের বিকাশে উল্লাস আছে। দ্বিতীয়, মিত্রের ভালোবাসা কন্ডিশনাল, শত্রুর দুশমনি আনকন্ডিশনাল। আরও একটি যোগ করা যায়_ মিত্ররা প্রকোষ্ঠ বিভাজনে পড়ে, শত্রুরা একাট্টা থাকে।
: লাস্ট প্রশ্ন। কোন কোন কথা বলতে গিয়ে আপনি নিজের বিপদ বাড়িয়েছেন, মিত্রকে কাঁদিয়েছেন ও শত্রুকে হাসিয়েছেন?
: শত্রুকে আমি হাসাইনি শুধু নয়, প্রতিশোধস্পৃহও করেছি। যে বিষয়গুলো আমি বলায় ও লেখায় বারবার উন্মাদের মতো টেনেছি, তার প্রারম্ভ পঙ্ক্তিতে পড়েছে_ মানুষ, মানবতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা; মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক, ছদ্ম সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ ও বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধার কথা, পরিচয় ও বিশ্বাসের অপরাধে মানুষ মানবসন্তানদের দলনকারী ও পীড়ক-উৎপীড়কদের কথা। আমি বলেছি মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস ও ব্যবস্থাপত্রের ইতিহাসের কথা; নিরপেক্ষতা ও উদারতার কথা, শিক্ষা ও রুচির কথা, মানবচরিত্রের সৌরভ ও গৌরবের কথা, সি্নগ্ধতা ও শুচিতার কথা।
: তাতে অসুবিধা হয়েছে কি?
: এতক্ষণ পর আবার এমন প্রশ্ন! অসুবিধা হয়েছে এই, কথাগুলো সবসময় এক পক্ষের বিপক্ষে গেছে।
: কোন পক্ষের?
: ভেবে বলুন!

রণজিৎ বিশ্বাস : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.