আইইবির সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী-আগামী প্রজন্মের জন্য কয়লা মজুদ রাখা হবে

দেশে যে পরিমাণ কয়লা আছে উত্তোলন না করে তা আগামী প্রজন্মের জন্য মজুদ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে আগ্রহীদের কয়লা আমদানি করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) ৫৩তম সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি জ্ঞান এবং গবেষণার মাধ্যমে সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে দেশের মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার জন্য প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সম্পদের সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত
করতে পারলে সীমিত সম্পদ দিয়েই অনেক মানুষকে সেবা দেওয়া যাবে। এ জন্য প্রকৌশলীদের দক্ষতা, সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। জনগণের ট্যাক্সের টাকার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আমরা বেতন-ভাতা নিই, তাই তাদের সেবাটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী প্রকৌশলীদের গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতেও পরামর্শ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে তার সরকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, বিগত সরকার একটি গ্যাসকূপও খনন করতে পারেনি। তবে গত তিন বছরে তার সরকার ১৪টি গ্যাসকূপ খনন করেছে। জাতীয় গ্রিডে মাত্র তিন বছরে সংযোজন করেছে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এখন থেকে কয়লাভিত্তিক যেসব কেন্দ্র স্থাপন করা হবে তা আমদানি করা কয়লা দিয়ে চালাতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। তাই কয়লা তুলতে গিয়ে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে। আর যে পরিমাণ কয়লা আছে তা আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা মজুদ রাখতে চাই।
২০০১ সালে গ্যাস নিয়ে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তাকে ও তার দলকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার কাছে দেশের স্বার্থ আগে। তাই তিনি তখন বলেছিলেন, চাহিদা অনুযায়ী ৫০ বছরের গ্যাস মজুদ থাকলে তবেই তিনি বাইরের দেশে গ্যাস বিক্রি করবেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা কয়লাভিত্তিক প্রকল্প করবেন তাদের শুরুতেই আমদানি করে কয়লার চাহিদা পূরণ করার শর্ত দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের শিক্ষার হার গত মেয়াদে প্রায় ২০ ভাগ বৃদ্ধি করে ক্ষমতা ছেড়েছেন; কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শিক্ষার হার পেয়েছেন মাত্র ৫০ ভাগ। এখন তা প্রায় ৫৫ ভাগ পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছে।
বর্তমানের আলোচিত ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) উদ্ভাবনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামরিক ও সেনা সমর্থিত সরকারের শাসনের কারণে দেশের গণতন্ত্র বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাই অবাধ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনে দেশের প্রকৌশলীদের উদ্ভাবিত ইভিএম মেশিন ব্যবহার করা হবে বলে জানান তিনি। তবে ইভিএম মেশিনে কোন প্রতীকে মানুষ ভোটা দিচ্ছে তা নিজ নিজ প্রতীকের পাশে ফ্ল্যাশের ব্যবস্থা করে দেখিয়ে দেওয়া যায় কি-না তার ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেন তিনি।
সম্মেলনে আইইবি সভাপতি প্রকৌশলী নুরুল হুদা সভাপতিত্ব করেন। এতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইইবির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সবুর, আইইবি ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মুনীর উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন।
'আঞ্চলিক সহযোগিতা আমাদের দর্শন' শীর্ষক স্লোগানে ৫৩তম সম্মেলনে আইইবি পদক প্রদান করা হয় প্রকৌশলী রুহুল মতিন, প্রকৌশলী ড. এমএকে আজাদ ও লে. কর্নেল (অব.) প্রকৌশলী নরুন্নবী খান বীরপ্রতীককে। এ বছর শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রের পুরস্কার অর্জন করে চট্টগ্রাম, শ্রেষ্ঠ উপকেন্দ্রের পুরস্কার অর্জন করে ফরিদপুর ও শ্রেষ্ঠ ওভারসিস চ্যাপ্টার হিসেবে পুরস্কার অর্জন করে সিঙ্গাপুর। কনভেনশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আইইবি চত্বরে একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ উন্মোচন করেন।
প্রকৌশলীদের মেধা প্রয়োগ করে দেশের মানুষকে সেবা প্রদান করার জন্য আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি দেশের জেলা ও উপজেলায় আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির জন্য আইইবিকে অনুরোধ জানান।
প্রধানমন্ত্রী আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন অনুমোদনের আগে সেখানে পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশনসহ সংশ্লিষ্ট সব সুযোগ-সুবিধা আছে কি-না তা নিশ্চিত হয়ে ডিজাইন ও প্ল্যান অনুমোদন করতে প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের শতকরা ৮৫ ভাগ অর্থ ব্যয় হয় প্রকৌশলীদের মাধ্যমে। তাই উন্নয়ন কাজের গুণগত মান বজায় রাখা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রকৌশলীদের কর্তব্যনিষ্ঠ ও সততার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকৌশলীরা মনোযাগী হলে সীমিত সম্পদের মধ্যেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব। প্রকৌশলীরা সঠিকভাবে সহায়তা করলে তার সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। বিদেশি যন্ত্রাংশের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে প্রধানমন্ত্রী প্রকৌশলীদের কৃষি ও শিল্পভিত্তিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করার পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। অথচ আমাদের অনেক মেধাবী মুখ রয়েছে, যারা শুধু লেদ মেশিন ব্যবহার করে অনেক যন্ত্রাংশ তৈরি করছেন। তাদের প্রশিক্ষণ ও পুঁজির ব্যবস্থা করে দেশেই কীভাবে যন্ত্রাংশ তৈরি করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বিদেশি দাতাদের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে দেশের স্বার্থে সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দাতা গোষ্ঠী একটি কাজ শুরু করতে বেশ উৎসাহ দেখায়। পরে আর তাদের তেমনভাবে পাওয়া যায় না। তাই তিনি দেশের সম্পদ উন্নয়নে কাজ করার আহ্বান জানান।
প্রকৌশলীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রায় ৪০ হাজার প্রকৌশলী মিলে একটি ফান্ড তৈরি করলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শুধু সরকারপ্রধানের দিকে তাকিয়ে না থেকে তিনি প্রকৌশলীদের নিজেদের একটি ফান্ড তৈরি করার পরামর্শ দেন। তবে শেখ হাসিনা প্রকৌশলীদের প্রতি তার সরকারের সমর্থন বরাবরের মতোই অব্যাহত থাকবে বলে আশ্বাস দেন।
অনুষ্ঠানে আইইবির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সবুর তার বক্তৃতায় বিভিন্ন সময় ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্সকে দেওয়া শেখ হাসিনার বিভিন্ন অনুদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে প্রকৌশলীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। এ সময় বক্তারা দেশের স্বার্থে বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন পদক্ষেপেরও প্রশংসা করেন।

No comments

Powered by Blogger.