উলফা নেতাদের গ্রেফতার নিয়ে ধূম্রজালঃ কার কথা সত্য?


ত কিছুদিনের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) বেশ ক’জন শীর্ষ নেতার বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের গোপনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ায় ভীষণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি অস্বীকার করতে চাইলেও মিডিয়ায় ফলাও প্রচারের ফলে শেষ পর্যন্ত কোনো ঘটনাই চাপা থাকেনি। প্রকাশ হয়ে পড়ে সরকারের দ্বিমুখী নীতি। এ ক্ষেত্রে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলেও আসামের আদালতে দাঁড়িয়ে উলফা নেতারা বাংলাদেশে তাদের গ্রেফতারের কথা জানিয়েছেন। সর্বশেষ স্বাধীন আসামের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্কুল শিক্ষক, উলফার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান প্রধান অরবিন্দ রাজখোয়াসহ অন্যদের গ্রেফতার চারদিকে হৈ চৈ ফেলে দেয়। তাদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়ার কথাও দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় বিশেষ প্রাধান্য পায়। তারপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সবকিছু ঝেড়ে অস্বীকার করেন। কিন্তু পরদিনই গৌহাটির আদালত প্রাঙ্গণে রাজখোয়া বাংলাদেশে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার কথা উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তোলেন। এবং এর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিশোধ গ্রহণের ঘোষণাও মিডিয়া সূত্রে জানা গেছে।

এই ঘটনার আগে উলফার অপর দুই কেন্দ্রীয় নেতা শশধর চৌধুরী ও চিত্রাবন হাজারিকাকে গ্রেফতার ও ভারতের হাতে তুলে দেয়ার প্রতিবাদ করে দলটির সামরিক মুখপাত্র রাজু বড়ুয়া মিডিয়ায় জানিয়েছেন, জীবনের নিরাপত্তার জন্যই তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা জানায়, উলফা আসামের জনগণের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নির্মম নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং জাতি ও ভাষাগত নির্যাতনের বিরুদ্ধেও তাদের সংগ্রাম চালাতে হচ্ছে। যার বিরুদ্ধে ভারত সরকার সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। ১৯৫৮ সালের আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট জারি করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সেনাবাহিনী সন্দেহভাজন যে কাউকে গুলি করে হত্যার অধিকার পেয়েছে। ফলে উলফা নেতাদের অনেকেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা রক্ষায় এদেশের জনগণ সবসময়ই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আইনের শাসনের প্রতি অবিচল আস্থাও সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় দু’দেশেই গ্রেফতার করা অনুপ্রবেশকারীরা নিজ নিজ দেশের আইন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। সে কারণেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্রেফতার হওয়া উলফার সম্পাদক অনুপ চেটিয়া এখনও বাংলাদেশের কারাগারে আটক আছেন। বর্তমান আওয়ামী মহাজোট সরকারের আমলে এমন কী হলো যে, আটক উলফা নেতাদের গোপনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া নিয়ে লুকোচুরি খেলা শুরু হয়েছে? বিজয়ের এই মাসে সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ড স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ—সেটাও সাধারণ মানুষের মনে বড় হয়ে উঠবে স্বাভাবিকভাবে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে নিকট প্রতিবেশী ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেমন হস্তক্ষেপ করা অনুচিত, ঠিক তেমনি সেখানকার জনগণের সংগ্রামের প্রতিও আমাদের সহানুভূতি থাকা দরকার। কোনোভাবেই কারও পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে দু’দেশের জনগণের মধ্যকার স্বাভাবিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব নষ্ট করার ফলাফল শেষ বিচারে ভালো হতে পারে না। বিপদাপন্ন মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে না পারি কিন্তু তাই বলে কাউকে ধরে হস্তান্তর করার পেছনে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি থাকতে পারে না। এটাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলাটা মোটেই ভুল হবে না।
তাছাড়া সরকারিভাবে হস্তান্তরের কথা অস্বীকার করার পরও যখন উলফা নেতারা আদালতে দাঁড়িয়ে জানান, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তখন সন্দেহ সৃষ্টি হয় কার কথা সত্য? এতে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়বে বৈ কমবে না। তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যায়, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে উলফা নেতারা গ্রেফতার হননি। সে ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে কে বা কারা তাদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে? তবে কি স্বীকার করে নিতে হবে ভিন দেশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এদেশে এতই শক্তিশালী ও সক্রিয় যে তারা সবকিছু উপেক্ষা করে ইচ্ছেমত কাউকে আটক করে নিয়ে যেতে পারে? তাদের বাধা দেয়ার সাধ্য কারও নেই? এ অবস্থায় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জননিরাপত্তা রক্ষায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।

No comments

Powered by Blogger.